আমার ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া একটি মজার ঘটনা - হাত ভেঙে যাওয়া"
প্রতিনিয়ত ছোটবেলার স্মৃতি হাতড়ে মজার মজার কিছু ঘটনা আপনাদের সামনে হাজির করে চলেছি । এর আগে আমার "কুকুরের কামড় খাওয়া" এবং চৈত্র মাসে "কাঁচা আমের গুঁটি চুরি করে খাওয়ার" দুটি ঘটনা শেয়ার করেছি । এবার শেয়ার করতে চলেছি আমার ছোটবেলার আরো একটি দুরন্তপনার মজার ঘটনা - কি ভাবে আমার ডান হাতের হাড় দু'টুকরো হয়, সেই ঘটনা ।
এখনো সে সব দিনের কথা মনে পড়লে অনাবিল হাসিতে হৃদয় পূর্ণ হয়ে ওঠে । এই হাত ভাঙার ঘটনা ঘটে যে বছর আমি কুকুরের কামড় খাই ঠিক তার পরের বছর । ক্লাস টু খুব সম্ভবত । ছ'বছর বয়সের ঘটনা ।
আমার বাবা ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে গিয়ে একটি মা-বাপ্ মরা ছোট ছেলেকে মাঠ থেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং নিজের ছোট ভাইয়ের মর্য্যাদা দান করেন । সেই ছেলেটি ভিন বর্ণের হওয়া সত্ত্বেও আমাদের ফ্যামিলি থেকে কোনোরকমের আপত্তি ওঠেনি কখনো, বরং আমার ঠাকুর্দা নিজের ছোট ছেলের মতোই করে তাকে মানুষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন । আমাদের ছিল যৌথ ফ্যামিলি । বিশাল পরিবার । বাবারা পাঁচ ভাই চার বোন । নতুন আরেকটি ভাই হিসাবে সেই ছেলেটি আমাদের ফ্যামিলিতে স্থান পেলো । ফলে, বাবারা হলো ছয় ভাই এবং চার বোন । মোট এগারোটা ঘর ছিলো আমাদের বাড়িতে । দাদু জীবিতবস্থায় হেঁশেল পৃথক হয়নি । তাঁর মৃত্যুর পরে সবাই আলাদা হয়ে যায় । আমার বাবা আমাদেরকে শহরে তাঁর নিজের কাছে নিয়ে যান ।
বড় হয়ে মায়ের কাছে শুনেছি মায়ের বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা । কাজের লোক, চাকর-বাকর, রাখাল-মুনিশ সব মিলিয়ে ছিল ১৫-১৬ জন আর যৌথ ফ্যামিলির লোক ছিল প্রায় ৪০-৪৫ জন, মানে সব মিলিয়ে ৫০-৬০ জন লোকের পাত পড়তো প্রতিদিন বাড়িতে । লম্বা টানা বারান্দায় দুপুরে সার সার পাত পড়তো । তিন বৈঠকে । আগে খেয়ে নিতো বাড়ির বয়স্ক, বাচ্চারা এবং বাবা-কাকা-জেঠুরা । এরপরে বাড়ির কাজের লোক, চাকর-বাকর এবং সবার শেষে বাড়ির মা-কাকীমা-বড়মা'রা ।
এহেন যৌথ ফ্যামিলিতে অনেকদিন পরে শোনা গেল সানাইয়ের রোশনাই । বাবার সব ভাই বোনের বিয়ে অনেক আগেই হয়ে গিয়েছিলো । বাকি ছিল শুধু বাবার সেই পালিত ভাই । আমার বাবাই অনেক খুঁজে ক্ষত্রিয় বর্ণের একটি ফ্যামিলির সন্ধান বের করেন । এবং সেই ফ্যামিলির বড় মেয়ের সাথেই আমার সেই কাকুর বিয়ে ঠিক হয় । বিয়ে তো হয়ে গেলো । এরপর কাকীমাকে নিয়ে আমরা চলে এলুম বাড়ীতে । আমার মনে আছে, অনেক খুঁজে একটি পাল্কীতে করে বউ নিয়ে রীতিমত শোভাযাত্রা করে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল ।
বৌভাতের দিন । সকাল থেকেই আমাদের যৌথ ফ্যামিলিতে আনন্দের হুল্লোড়, বিশেষ করে আমাদের ভাই বোনেদের মধ্যে । আমার সমবয়সী কাজিনরাই ছিল প্রায় ৮-১০ জন । এরপরে আমার চার পিসিমাদের বাড়ি থেকেও এলো এক গাদা আমার সমবয়সী ভাই বোন । সারাক্ষন হৈ হুল্লোড়, চেঁচা-মেঁচি, দৌড়াদৌড়ি আর কত রকমের যে খেলাধুলা তার ঠিক নেই ।
আমার এক কাজিন ছিল বিশাল মোটাসোটা । আমার ছোট কাকার ছেলে । প্রায় আমার সমবয়সী । তার ডাক নামটাও ছিল তার চেহারার অনুরূপ - ভোঁদো । আমি তখন একেবারে আমার ছেলে টিনটিনের মতোই রোগা-পাতলা । আমার ডাক নাম ছিল তখন "ছোট্ট", পরে এটা চেঞ্জ হয়ে যায় অবশ্য । দারুন জোরে ছুটতে পারতাম । তো, হঠাৎ করেই আমাদের মধ্যে শুরু হলো দৌড়ের কম্পিটিশন ।
বাজি ধরে দৌড় । তাই সবাই প্রাণপণে ছোটার চেষ্টা করছি । এমন সময় কলিশন । ভোঁদো-র সাথে আমার । এত জোরে এসে আমি ভোঁদোকে ধাক্কা দিলাম যে সংঘর্ষের শব্দ উঠলো একটা । আর ভোঁদো-র বিশাল ওজনদার শরীর যেমন ছিলো তেমনই থাকলো, কিন্তু রোগা পাতলা বেচারি আমি প্রায় সাত হাত দূরে ছিটকে গিয়ে পড়লাম । ধপ্পাস ।
পড়ার গতিবেগে এবং আঘাতের অভিঘাতে আমার হাঁটু ভাজ হয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেলাম ধুলোতে । বেকায়দায় ডান হাতটা পড়লো পেটের তলে, আড়াআড়ি ভাবে । সবাই ছুটে এলো কাছে । আমার আর এক কাকু (আমার বাবার কাজিন) দৌড়ে এসে আমাকে কোলে তুলে নিলো । এবং তখনই আমি আবিষ্কার করতে পারলাম যে আমার ডান হাত আর আমি নাড়াতে পারছি না ।
চললো পাখার বাতাস, তেল-জলের মালিশ অনবরত । কিন্তু মালিশ করতে গেলেই ব্যাথায় চিৎকার করে উঠি । তখনই আমার ছোটকাকা সন্দেহ প্রকাশ করলো যে হাত ভেঙেছে । বাবা একটু পরেই এলো । তাঁর তখন প্রচুর কাজ । বৌভাতের বাড়ি - কাজের চাপ তো থাকবেই । আমার অবস্থা দেখে প্রথমে মারতে এলো, পরে অবশ্য আমার চোখে জল দেখে আর মায়ের ধমকে বাবা মারার কাজটা মুলতবি রেখে আমাকে আমার এক কাকার জিম্মায় রেখে নিজের কাজে চলে গেলো ।
রাত্রে কিছুই খেতে পারলাম না ব্যাথার চোটে । সারারাত ঘুমোলাম শামিয়ানার তলে একটি খাটে । অতি প্রত্যুষেই আমার ছোট কাকা আমাকে নিয়ে শহরে গিয়ে এক্সরে করিয়ে হাতে ব্যান্ডেজ পরিয়ে নিয়ে এলো । ব্যান্ডেজ পরা ডান হাত ঝুলতো আমার গলা থেকে দড়ি দিয়ে । প্রায় একটি মাস ব্যান্ডেজ ছিলো হাতে । এই একটি মাস স্নান করা থেকে খাওয়া দাওয়া, ঘুম এসব কিছুই হতো মায়ের কোলে । মা'কে কাছ ছাড়া করতে চাইতাম না একটি মুহূর্তও । আর একটি ভারী মজার ঘটনা ঘটেছিলো । আমার এত রোগা পাতলা শরীর দেখে ডাক্তার ভিটামিন এর বোতল দিয়েছিলো মোট ছয়টি, দুই মাসের জন্য । কি ছিলাম আর কি হলাম । ছিলাম নেংটি আর এখন হস্তী ।
প্রায় এক মাস পরে ব্যান্ডেজ কেটে আমার ডান হাতটাকে ফিরে পেলাম ।
Amazing
দাদা গত কয়েকদিন থেকে আপনার ছোটবেলার ঘটনা পড়ছি,, সত্যিই অনেক মজা পাচ্ছি। আসলে আমি ভাবতাম যে হয়তো আমার ছোটবেলায় এরকম দুরন্ত কেটে ছিল কিন্তু না দেখি এখন সবারই ছোটবেলা চরম দুরন্ত ছিলো এবং সকলেই অনেক ধরনের দুষ্টুমি করে ছিল। এরকম বাজি করে দৌড়ানো হয়নি তবে কম্পিটিশনে অনেকবার দিয়েছিলাম তবে হ্যাঁ প্রত্যেকটা দলের মধ্যে একটু নাদুস-নুদুস কেউ থাকে। তবে আপনি ৬-৭ হাত দূরে পরে গিয়েছিলেন তা সত্যি অবার করা বিষয় ছিলো।
দাদা এটি বেশ মজার কথা ছিল।আপনার গল্পগুলো সত্যিই অনেক মজার যদিও হাত ভাঙার গল্পটি একটু দুঃখজনক।ছোটবেলায় সকল গ্রামের বাচ্চাদের জীবন মনে হয় কিছুটা এমন হয়।কোনো না কোনো কিছু ভাঙার গল্প জীবনে থাকবেই।ধন্যবাদ দাদা।
বেশ মজার ছিলো দৃশ্যটা তাইনা, আমি কল্পনা করেই হাসতে হাসতে শেষ, আহারে পাতলা হলে কি কষ্ট হা হা হা । বেশ মজার ছিলো আপনার ছোটবেলাটা বেশ বুঝতে পারছি এখন।
বিশ্বাস করেন দাদা আমি কতোটা মজা পেলাম আপনার এই গল্প পড়ে বিশেষ করে এই লাইন গুলো। হাসতে হাসতে মরে গেলাম। হাহাহাহাহাহা
ভোঁদো,,,,,,, এই নামটা শুনলেই হাসি পাচ্ছে আমার। হাহা অনেক অনেক ধন্যবাদ দাদা।
এমন একটা মোটা তাজা ট্রাকের সাথে ধাক্কা খেয়ে কিভাবে ছিটকে পড়লেন, এটা ভাবতেই হাসি চলে আসছে। 😄😄😁😁
দাদা আপনার শৈশব স্মৃতির সাথে আপনার পরিবারের অনেক মজার গল্প পড়ে ভালো লাগলো। আসলে বর্তমান সময়ে যৌথ পরিবার আর খুব একটা দেখা যায়না। শৈশব বড় সুন্দর ছিল। তবে আপনি আপনার কাজিন ভোঁদো দাদার সাথে দৌড় কমপিটিশনে গিয়ে আপনার হাত ভেঙেছে এটা যেনে খারাপ লাগলো। আপনার ছোটবেলার গল্প পড়ে খুবই ভালো লেগেছে দাদা। আশা করছি এরকম মজার মজার সব গল্প আবারো শেয়ার করবেন। এই প্রত্যাশা করছি দাদা।
আপনার ছোটবেলা আসলে খুবই রঙ্গীন এবং আনন্দময় কেটেছে যৌথ পরিবারের সঙ্গে ।যৌথ পরিবার এখন তো আর দেখাই যায় না ।এখনকার ছেলেমেয়েরা যৌথ পরিবারের আনন্দটা আসলেই অনেক বেশি মিস করে।যদি আপনার হাত ভাঙ্গার ঘটনাটা পড়ে একটু খারাপ লেগেছে।একমাস আপনার হাতে ব্যান্ডেজ ছিল নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেয়েছেন। ধন্যবাদ আমাদের সাথে আপনার ছোটবেলার এই ঘটনাটা শেয়ার করার জন্য।
ছবিটা দেখে ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেলে।
দাদা আমি শুনেছিলাম উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের কে বাড়ির সীমানাতেই প্রবেশ করতে দিতেন না সেখানে আপনার দাদু নিম্নবর্ণের এক ছেলেকে তার সন্তানের মর্যাদা দিয়েছিল ভাবতেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। আর এত বড় যৌথ পরিবারের কথা এখন তো কল্পনাও করা যায় না। শৈশবে আপনার দস্যিপনার যেইসব গল্প একটু একটু করে শুনতে পাচ্ছি তাতে বলতেই হয় আপনি ছিলেন বিচ্ছু সরদার হাহাহাহা।