গল্প : "শ্রাবণ সন্ধ্যায়"
কপিরাইট ফ্রী ইমেজ সোর্স : পিক্সাবে
[বিঃ দ্রঃ নিচের গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা । আমাদেরই পরিবারে অনেক কাল আগে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক ঘটনা অবলম্বনে নিচের গল্পটি রচিত]
সে অনেক কাল আগের কথা । গ্রামের এক অবস্থাপন্ন গৃহস্থ বাড়িতে তখন কর্মব্যস্ত দিনের শেষভাগ । শ্রাবণ মাস । তাই কাজের চাপটাও একটু বেশি । এই সময়টাতে গ্রামে আউশ ধান লাগানোর সময় । আউশ মূলত বৃষ্টি নির্ভর ধান । আষাঢ় মাসে বীজতলা তৈরী করে শ্রাবণ মাসে চারা রোপন করা হয় ।
এই সময়টাতে গ্রামে তাই কৃষকদের বাড়তি চাপ থাকে । সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই মাঠে চলে যায় তারা । তারপর সারা দিনমান ধরে ধানের চারা রোপন করে সন্ধ্যার প্রাক্কালে ঘরে ফেরে । কাজের চাপের জন্য বাড়িতে খেতেও আসতে পারে না তারা । ভোরে উঠে বড় বড় গামলায় গামছা দিয়ে বেঁধে পান্তা ভাত, নুন, তেঁতুল আর কাঁচা লঙ্কা নিয়ে মাঠে চলে যায় তারা । ক্ষেতের কাজ শুরু করার আগে এক পেট পান্তা খেয়ে নেয় ।
এরপরে দুপুরের দিকে বাড়ি থেকে ভাত, ডাল আর তরকারি দিয়ে যায় আবার গামলায় করে গামছা বেঁধে । কাজের ফাঁকে তাই দিয়েই উদরপূর্তি করে কিষানেরা । তারপর আবার নিরবিচ্ছিন্ন কাজ । সন্ধ্যেয় ঘরে ফিরে একদম সাঁঝের বেলাতেই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তারা ।
এই গৃহস্থ বাড়ির অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর । সারা শ্রাবণ মাস জুড়ে প্রতিদিন ১০-১৫ জন কিষান কাজ করে এই বাড়িতে ।
সারাটা দিন আজ আকাশে মেঘ করে ছিল । কিষানেরা সব মাঠে । সকাল থেকেই থেকে থেকে ঝেঁপে বৃষ্টি এসেছে । দিনের শেষভাগে এখন আর ততটা বৃষ্টি নেই, তবে গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছে এখনো ।
বাড়ির কর্ত্রী ঠাকুমা । ভয়ানক তেজি মহিলা । অতীতে এ বাড়িতে বহুবার ডাকাতি হয়েছে । কিন্তু, যেবার সব চাইতে ভয়ানক ডাকাতি হওয়ার পর ডাকাতেরা চেঁছেপুঁছে সব নিয়ে গেলো সেবারে এই বাড়ির ঠাকুমা ডাকাতদের পেছু নিয়ে হোগলা বনের ভেতর ডাকাতদের সর্দারের কাছে পৌঁছে গেলেন ।
সে যুগে ডাকাতরা ছিল অতি ভয়ঙ্কর । বিশেষ করে বাগদী ডাকাতেরা । এদের দয়ামায়া বলে কিছু ছিল না । সামান্য কিছু টাকা পয়সা বা একখানি পুরোনো কাপড়ের জন্যও এদের মানুষ খুন করতে হাত কাঁপতো না । মেয়েদের গলার হার ছিনিয়ে নেওয়ার এদের সহজ পন্থা ছিল এক কোপে গলাটা নামিয়ে দিয়ে । কারণ খুলতে গেলে অনেকটা সময় লাগে । তাহলেই ভুঝে নিন কি ভয়ঙ্কর ডাকাত ছিল এরা । ব্রিটিশরা বহু চেষ্টা করেও ডাকাতদের সাথে পেরে ওঠেনি ।
এই ভয়ানক ডাকাত সর্দারকে নিজের ধর্ম ভাই বানিয়ে ঠাকুমা লুঠ করা সব মাল তো ফেরত পেয়েছিলেনই উপরন্তু ডাকাত সর্দারের কাছ থেকে বোন হিসেবে অনেক সোনাদানাও পেয়েছিলেন ।
এ হেন ঠাকুমা এদিন সকাল থেকেই খুব ব্যস্ত ছিলেন । বাড়িতে চাল বাড়ন্ত । তখনকার দিনে তো আর চালকল ছিল না । ধান থেকে চাল বের করার একটাই উপায় ঢেঁকি । ঠাকুমা তাই সকাল থেকে দু'দুটো ঢেঁকি ঘরে তদারকিতে ব্যস্ত । প্রায় দশ মন ধান ভেনে তা থেকে চাল বের করা হচ্ছে । বাড়িতে পাত পড়ে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটটা । প্রতিদিন তিন বেলায় পঞ্চাশ-ষাট জনের ভাত রান্না হয় । কি পরিমাণ চাল প্রয়োজন হতো তাহলে সেটা সহজেই অনুমেয় ।
ঢেঁকিতে ধান ভানা শেষ হতে হতে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো । ঠাকুমার সান্ধ্য স্নানের সময় হয়ে এলো । বুড়ির ভাষায় গা ধোওয়া । ঠাকুমা অতি প্রত্যুষে উঠে বাড়ির পেছনের খালে স্নান করে নিতেন । বাড়িতে বিশাল একটা শান বাঁধানো পুকুর ছিল । কিন্তু, বুড়ির অভ্যাস ছিল খালের জলে স্নান করা । বদ্ধ জলাশয়ে স্নান করলে তাঁর নাকি অশুচি লাগতো ।
বর্ষার খাল । জলে টইটম্বুর । ভয়ানক স্রোত তাতে । খাল তখন আর খাল নেই, নদীর আকার ধারণ করেছে । বর্ষাকালে খাল এমনই থাকে । বছরের অন্য সময়টাতে তাতে জলের শীর্ণ প্রবাহ থাকে ।
সন্ধ্যা তখনো হয়নি । আকাশে কিছুটা আলো আছে, কিন্তু মেঘলা হওয়ার কারণে মনে হচ্ছে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে । ঠাকুমার পুজো আহ্নিকের তাড়া । দ্রুত তাই ঢেঁকিঘরের মেয়েদের বললেন চালগুলো ধামায় করে সাজিয়ে রাখতে । এরপরে নিজের খাস ঝি-কে ডেকে ক্ষার, তেল আর গামছা নিয়ে খালের পাড়ে যেতে বললেন ।
আগেকার দিনে সাবান ছিল না গ্রামে । মানুষ ক্ষার দিয়ে শরীর পরিষ্কার করতো স্নানের সময় ।
খালের পাড়ে এক স্থানে তাল গাছের গুঁড়ি কেটে কেটে তা দিয়ে সুন্দর পৈঠা তৈরী করা হয়েছে । এটাই ঘাট । ঝি এসে ঘাটের কাছে দাঁড়ালো । তার এক হাতে ক্ষার, অন্য হাতে তেলের শিশি, কাঁধে গামছা । চারিদিকে বেশ আঁধার ঘনিয়ে এসেছে । গুঁড়ি গুঁড়ি হালকা বৃষ্টি হচ্ছে এখনো । ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি ।
খালের পাড়ে শোঁ শোঁ করে উথাল পাথাল হাওয়া উঠেছে । ভেজা শীতল হাওয়া । বেশ শীত শীত করে এমন হাওয়াতে । চারিদিকে ব্যাঙ আর ঝিঁঝিঁ পোকার অবিশ্রান্ত ডাকে কান পাতা দায় । দূরে কোথাও শিয়াল ডাকছে - হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া ।
গৃহস্থ বাড়িগুলো থেকে ঘন্টা, কাঁসা আর শঙ্খ ধ্বনি ভেসে আসছে ।
একটা শান্ত, বৃষ্টি ভেজা শ্রাবণ সন্ধ্যা ।
এমন সময় ঠাকুমা এসে দাঁড়ালেন ঘাটের পৈঠার কাছে । ঝি-র কাছ থেকে তেল নিয়ে মাথায় মাখলেন । তারপরে পৈঠায় পা দিয়ে ধীর পায়ে নেমে গেলেন খালের জলে । একটা ছোট ডুব দিয়ে এসে ক্ষার দিয়ে গা-হাত-পা দলবেন, এটাই ছিল তার ইচ্ছে । কিন্তু, পৈঠার শেষ ধাপে পা দিতেই সহসা কি জানি হয়ে গেলো ।
মুহূর্ত মাঝে খালের জলে হঠাৎ ভীষণ একটা আলোড়ন উঠলো । একটা ঝটাপটির শব্দ, ঠাকুমার মৃদু একটু গোঙানি, আর তারপরে ঝপাস করে একটা শব্দ । ঘাটের শেষ পৈঠার কাছে আগে থেকে ওঁৎ পেতে ছিল বিশালকায় এক লোনা জলের কুমির । সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত ।
তারপর আবার সব শান্ত। ঝি-র আতঙ্কিত চোখের সামনে শুধু খালের জলে একটা রক্তের স্রোত মিশে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে । বিশাল একটা খাঁজ কাটা লেজ একবার জলের উপর ভেসে উঠেই আবার তলিয়ে গেলো ।
দূর থেকে তখনো ভেসে আসছে কাঁসার টং টং শব্দ, শঙ্খধ্বনি । জীবন অনিত্য, মৃত্যু অমোঘ, মৃত্যুই সত্য !
------- ধন্যবাদ -------
পরিশিষ্ট
Account QR Code
VOTE @bangla.witness as witness
OR
গল্পের শেষে যে এমন একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটবে কোন ভাবেই বুঝতে পারিনি।শুরুটা বেশ দারুন ছিলো।একটু কাহিনী পড়লে বাকিটুকু না পড়ে শান্তি নেই। আমি নিজেও ঢেঁকি দেখেছি যদিও এখন ঢেঁকি নেই। যাই হোক যদিও মর্মান্তিক তবে পড়ে বেশ ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ
খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। আগের দিনে শুনতাম পুকুরে খাল বা ডুবায় কুমির থাকতো। তবে কখনো নিজ চোখে দেখা হয়নি। কে জানতো ঐ খালের গোসলই তার জীবনের শেষ গোসল। মৃত্যুই সত্য। তবে দাদা ক্ষার কি সেটা বুঝলাম না। বুঝিয়ে দিলো ভালো হতো। ধন্যবাদ দাদা।
গল্পটি যতই পড়ছিলাম দাদা মনে হয় আগেরদিনে হারিয়ে যাচ্ছিলাম।আগের দিনে সাবান ছিল না ক্ষার দিয়ে শরীর পরিষ্কার করত।
ঘাটে গোসল করতে গিয়ে যে এত বড় বিপদ হবে কে জানত ।গল্পটি পড়ে গা শিউরে উঠছিল। কারন একটি জলজ্যান্ত মানুষ এক নিমিষেই চলে গেল চোখের সামনে।কে জানত এটা তার শেষ গোসল।ক্ষারের গল্প আমিও শুনেছি মার কাছ থেকে কিন্তু কখনো চোখে দেখিনি।ধন্যবাদ দাদা সুন্দর একটি পোস্ট আমাদের মাঝে শেয়ার করার জ ন্য।
Congratulations, your post has been upvoted by @upex with a 41.07% upvote. We invite you to continue producing quality content and join our Discord community here. Keep up the good work! #upex
Congratulations, your post has been upvoted by @nixiee with a 100 % upvote Vote may not be displayed on Steemit due to the current Steemit API issue, but there is a normal upvote record in the blockchain data, so don't worry.
This is a nice story but at first I didn't believe it is a true story.
I later believe believe it is a true story because Dada said so.
Thanks for sharing this with us Dada ❤️❤️❤️
এই কাহিনীটা আমার কাছেও অনেক পরিচিত লাগলো দাদা । এ ধরনের একটা গল্প মনে হয় আপনার কোন একটা লেখায় পড়েছিলাম এটার সাথে অনেক মিল, মনে হয় সাপের গল্পের ভিতরে ছিলকিনা । আমি তো প্রথম থেকেই ভয়ে ভয়ে অস্থির ছিলাম মনে করেছিলাম ভুত আসবে , পরে দেখলাম যে কুমির খেয়ে ফেলল । কুমির আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ভয়ে ভয়ে গল্পটি পড়ছিলাম । আর ডাকাত দলের সর্দারের সাথে কিভাবে ধর্ম বোন বানিয়ে তার সবকিছু ফেরত পেল এই গল্পটা জানতে ইচ্ছা করছে । এরকম ভয়ের গল্প আরো দিয়েন দাদা পড়তে ভালো লাগে ।
Thank you, friend!
I'm @steem.history, who is steem witness.
Thank you for witnessvoting for me.
please click it!
(Go to https://steemit.com/~witnesses and type fbslo at the bottom of the page)
The weight is reduced because of the lack of Voting Power. If you vote for me as a witness, you can get my little vote.
যেকোনো গল্প যত ভালো উপস্থাপনা হয় সেই গল্প পড়ার মধ্যেও অনেক মজা খুঁজে পাওয়া যায়। শ্রাবণ সন্ধ্যায় আসলে সেই সময়ের মানুষের সাহসিকতা বর্তমান সময়ে যেটা অবাক করে । ঠাকুমার সেই সাহসিকতা ডাকাতকে ভাই বানিয়ে ডাকাতের কাছে ডাকাতি করা। নিজেই তাদের ডাকাতি করা সবকিছু ছিনিয়ে নিতেন দারুন একটা বুদ্ধি। খুবই ভালো লেগেছে এইটুকু। তাছাড়া কুমিরের আক্রমণ সত্যি সেই সময়ের ভয়ানক গল্প গুলো পড়তে এবং শুনতে ভালো লাগে।
দাদা এর আগে আপনার একটি পোস্টে পড়েছিলাম, আপনার ঠাকুমা ডাকাত সর্দারকে নিজের ধর্ম ভাই বানিয়ে অনেক সোনাদানা পেয়েছিলেন। উনি আসলেই বেশ সাহসী মহিলা ছিলেন। যাইহোক মানুষ মরণশীল এবং কখন কার মৃত্যু হবে, সেটা কেউ বলতে পারে না। তবে এমন মর্মান্তিক মৃত্যু আসলেই মেনে নিতে কষ্ট হয়। যাইহোক বাস্তব গল্পটি আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা।
আমার ঠাকুমা নয় । উনি ছিলেন আমার বাবার ঠাকুমা ।
ওহ্ আচ্ছা, আপনার বাবার ঠাকুমা আসলেই খুব সাহসী ছিলেন দাদা। নয়তোবা ডাকাত সর্দারকে নিজের ধর্ম ভাই বানিয়ে, নিজেদের বাড়ি থেকে লুঠ করা সব মাল ফেরতও এনেছে, আবার বোন হিসেবে ডাকাত সর্দারের কাছ থেকে সোনাদানাও এনেছে। বলতে গেলে এটা সিনেমার কাহিনীকেও হার মানিয়েছে।