বন্ধু
Copyright Free Image Source:Pixabay
বহুদিন আগে আমি একটা ছোট গল্প লিখেছিলাম Steemit -এ । গল্পটির নাম ছিল "টিনের পিস্তল" । আজকের সেই গল্পটির পেছনের ইতিহাস আপনাদের মাঝে শেয়ার করবো । "টিনের পিস্তল" গল্পটি আসলে আমার নিজের জীবনেরই একটা বেদনামাখা টুকরো স্মৃতির উপর ভিত্তি করে লেখা ।
আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়তাম তখন আমরা শহরে থাকতাম, সেই সময়কার একটা ঘটনার উপরে ভিত্তি করে এই গল্পটি লিখি আমি । গ্রামে ক্লাস ফোর অব্দি পড়েছি আমি, আর তারপর থেকেই শহরে । খুব সম্ভতঃ তখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি, আমার বাবার গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে বাসন্তী পুজো উপলক্ষে গিয়েছি । প্রতি বছর কালীপুজো আর বাসন্তী দূর্গা পুজোর সময় আমরা বাবার গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে যেতুম । সেবারও গিয়েছি, এই চৈত্র মাসের শেষ দিক তখন । চড়ক পুজোর মাত্র সপ্তাহ দু'য়েক আগেই পড়েছিল সেবার বাসন্তী পুজো ।
আমাদের পৈতৃক বাড়িতে খুব ধুমধামের সহিত বাসন্তী পুজো হয়েছিল সেবার । আমাদের বারবাড়িতে একটা বহু পুরোনো চণ্ডীমণ্ডপ ছিল । সেখানেই হয়েছিল পুজো । এছাড়াও গ্রামে খুব ধুমধাম করে বাসন্তী পুজো হতো প্রতি বছর । এই বাসন্তী পুজো উপলক্ষে পাঁচ দিন ধরে বিশাল মেলা বসতো পুজোর মাঠে ।
সেবার মেলা থেকে একটা টিনের পিস্তল কিনে দিয়েছিলো আমার বাবা । দশ টাকা দাম নিয়েছিল পুরো । এই পিস্তলের ঘাড় ভেঙে বারুদের স্ট্রিপ ভরতে হতো । এই স্ট্রিপ গোল করে পেঁচানো থাকতো পিস্তলের ভেতর । ঘোড়া টানলে অটোমেটিক স্ট্রিপের রোলটা একটু উপরে উঠে যেত আর হ্যামারটা এসে ঠিক ঘা মারতো বারুদের রোলের একটা স্ট্রিপের উপর । সঙ্গে সঙ্গে ধুম করে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতো বারুদ । সাদা ধোঁয়ায় ঢেকে যেত আশপাশ ।
দারুন খেলনা ছিল আমাদের ছোটদের কাছে এই টিনের পিস্তল । আমাদের গ্রামে আমার অনেকগুলো বন্ধু-বান্ধব ছিল, তবে তেমন করে ঘনিষ্ঠতা ছিল না প্রায় কারো সাথেই । কারণ, আমরা থাকতুম শহরে, তাই গ্রামের ছেলেদের সাথে বছরে মাত্র দু-তিন বারের বেশি মেশার সুযোগ পেতুম না । তারপরেও অল্প কিছুদিনের ঘনিষ্ঠতা থেকেই বন্ধুত্বের জন্ম হয়েছিল । এই সময় একটা ঘটনা ঘটেছিলো আমার জীবনে । এই ঘটনার কথা মনে পড়লে এখনো দুঃখ পাই আমি ।
টিনের পিস্তলটা কেনার পর খুব ডাঁটের মাথায় সকাল-বিকেল দু'বেলা গ্রামের রাস্তায় বন্ধুদের সাথে বের হয়ে পিস্তল ফোটাতাম । খুব মান্য করতো সবাই আমাকে, একটিবারের জন্য পিস্তল ফোটানোর জন্য সবাই মুখিয়ে থাকতো । যাকে খুশি তাকে দিতাম পিস্তল দিয়ে দুম ফটাশ করতে । একদিন আমাদের এক বন্ধু, নাম রথীন এসে বিস্তর ঝোলাঝুলি করতে লাগলো আমার পিস্তলটা ফোটানোর জন্য । আগের দিন সন্ধ্যাবেলা তাকে দিয়েছিলাম ফোটাতে, কিন্তু, বিস্তর ফুটিয়ে আমার বারুদের ভাঁড়ার প্রায় শেষ করে এনেছে । এক একটা বারুদের স্ট্রিপ রোলের দাম ছিল ১ টাকা করে । বাবা আমাকে ১০টি স্ট্রিপ কিনে দিয়েছিলো, কিন্তু, এই ক'দিনের মধ্যেই স্ট্রিপ ফুরিয়ে এসেছে । আর গতকাল সন্ধ্যেতে তো রথীন একাই দু'দুটো স্ট্রিপ ফুটিয়ে ফেলেছে । তাই এদিন বিস্তর ঝোলাঝুলি করলেও তার হাতে পিস্তল দিলাম না আমি ।
ফলশ্রুতিতে পরের দিন সকাল থেকেই আমার পিস্তল মিসিং । বিস্তর খুঁজেও শেষে না পেয়ে আমার সন্দেহ হলো যে এটা রথীনেরই কাজ । বাবার কাছে রথীনের নামে নালিশ জানাতে গিয়ে খেলুম ধমক । পরের দিন অবশ্য বাবা মেলা থেকে আর একটি টিনের পিস্তল কিনে দিয়েছিল আমায়, কিন্ত, তারপরেও আমার আগের পিস্তলটা হারানোর শোক ভুলতে পারিনি । তবে, এই ঘটনার পর থেকে আমি রথীনের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম এটা বেশ মনে আছে ।
এরপরের বছর পুজোর সময়ও গ্রামে গিয়ে রথীনের সাথে কথা বলিনি, খেলিনি । অবশ্য রথীনের সাথে আমার দেখাই হয়নি মোটে সে বছর । পুরোনো বন্ধুদের কাছে শুনেছিলাম যে রথীনের নাকি কী একটা ভয়ানক শক্ত অসুখ করেছে, সারছে না মোটে । রথীনকে তাই কলকাতার বড় ডাক্তার দেখানোর কথা ভাবা হচ্ছে । যাই হোক, সে বছর আমি গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসার আগে আর রথীনের সাথে দেখা হয়নি ।
এরপরের বছর আবার পুজোর সময় গ্রামে গিয়ে শুনি টাকার অভাবে রথীনকে আর কোলকাতায় নেওয়া সম্ভব হয়নি । এখানকার ডাক্তাররা তেমন কোনো আশা দিতে পারেনি । শুনে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো । পুজোর দিন কিন্তু রথীনের সাথে অকস্মাৎ দেখা হয়ে গেলো । আমাদের পুজো মণ্ডপে তার ঠাকুমার সাথে এসেছে পুজোর আশীর্বাদক ফুল-বেলপাতা মাথায় ছোঁয়াতে আর প্রণাম করতে । শরীরটা একদম শীর্ন আর ভয়ানক দুর্বল, চোখ দু'টিতে অসহায় করুণ চাউনি, পেটটা অনেকখানি ফুলে গিয়েছে, গায়ের চামড়া রক্তহীন ঈষৎ হলদেটে । নতুন একটা রোগের নাম শুনলাম সেদিন - "জন্ডিস" । রথীনের জন্ডিস হয়েছে, কিন্তু আজ একটি বছর হয়ে গেলো সারছে না । দিন দিন সে আরো দুর্বল আরো শীর্ন হয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে । শিউরে উঠেছিলাম সেদিন ।
সেদিনও রথীনের সাথে কথা বলিনি আমি । রথীন একবার মাত্র আমার দিকে করুণ একটা চাউনি দিয়ে ধীরে ধীরে ঠাকুমার কোলে করে চলে গেলো ।
যেদিন বিসর্জন হবে তার ঠিক আগে ভোরবেলায় রথীনের এক বন্ধু এসে আমাকে একটা ছেঁড়াখোঁড়া ন্যাকড়া দিয়ে জড়ানো পুঁটুলি দিয়ে গেলো, বললো রথীন দিয়েছে আমাকে । বালকসুলভ কৌতূহলবশে সঙ্গে সঙ্গে পুঁটুলিটা খুলে ফেললুম । কী দেখলুম ? দেখলুম একটা জং ধরা পুরোনো টিনের পিস্তল । রথীন আমাকে আমার জিনিস ফিরিয়ে দিয়েছে ।
না, আর তার সাথে জীবনে কোনোদিন দেখা হয়নি আমার । এই ঘটনার পরে আর মাত্র মাস দুই বেঁচে ছিল রথীন । বড় হয়ে জেনেছি রোগটার সঠিক নাম ছিল "হেপাটাইটিস বি" । এতকাল হয়ে গেলো এখনো মাঝে মাঝে শেষ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে রথীনের কথা মনে পড়ে । তার সাথে আমার কোনোদিনই তেমন গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল না ঠিক, তবে তার মৃত্যুটা আমার বালক মনে এক সুগভীর প্রভাব ফেলেছিলো । আজও চোখ বুজলে যেন দেখতে পাই সে বিষাদমাখা দু'টি করুণ চোখের চাহনি, সেই ন্যাকড়ায় জড়ানো জং ধরা একটা টিনের পিস্তল ।
------- ধন্যবাদ -------
পরিশিষ্ট
Account QR Code
VOTE @bangla.witness as witness
OR
দাদা আপনার লেখাগুলো পড়ে কখন যেন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। আসলে ছোটবেলার সেই স্মৃতিগুলো আমাদের মনে সব সময়ের জন্য জায়গা করে নিয়েছে। রথীনের এই করুন পরিণতি আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। টিনের পিস্তলের সাথে সাথে আপনার সেই বন্ধুর স্মৃতিটি সারাজীবন আপনার মনে থেকেই যাবে।
Thank you, friend!
I'm @steem.history, who is steem witness.
Thank you for witnessvoting for me.
please click it!
(Go to https://steemit.com/~witnesses and type fbslo at the bottom of the page)
The weight is reduced because of the lack of Voting Power. If you vote for me as a witness, you can get my little vote.
Congratulations, your post has been upvoted by @upex with a 40.52% upvote. We invite you to continue producing quality content and join our Discord community here. Keep up the good work! #upex
Congratulations, your post has been upvoted by @nixiee with a 100 % upvote Vote may not be displayed on Steemit due to the current Steemit API issue, but there is a normal upvote record in the blockchain data, so don't worry.
রথীন এর এই স্বল্প দৈর্ঘ্য জীবনের কাহিনী পড়ে বেশ খারাপ লাগছে। এই বেদনা মাখা স্মৃতি আপনাকে জীবনের শেষ অব্দি নিয়ে যেতে হবে। যেহেতু কোন ঘটনা কখনোই মন থেকে একেবারে মুছে যায় না তাই এই ঘটনার রথীনের সেই বিষাদ অসহায় মুখ বার বার চোখে ভেষে উঠবে। যদি শেষে একবার হলেও তার সাথে কথা বলতেন।
আপনার বাবা মেলা থেকে একটা টিনের পিস্তল কিনে দিয়েছিল ।পিস্তলটি ১০ টাকা নিয়েছিল পিস্তলটি মারলে চারিদিকে সাদা ধোয়াই ঢেকে যেত ।একটা বারুদের স্ট্রিপ রোলের দাম ছিল ১ টাকা করে ।ফলশ্রুতিতে পরের দিন সকাল থেকেই আমার পিস্তল মিসিং ।হয়তো আপনার বন্ধু নিয়ে নিয়েছিল ।রথীনের জন্ডিস হয়েছে, সে মাত্র দুই বছর বেঁচে ছিল । আসলেই কোন বন্ধু যদি চোখের সামনে এমন ভাবে মারা যায় অনেক দুঃখজনক বিষয় ।ছোটবেলায় সেই স্মৃতিগুলো মনে হলে খুব খারাপ লাগে ।ধন্যবাদ দাদা আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইল।
পুরো পোস্টটি পড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম দাদা, আসলে আমাদের কর্মফল মাঝেমাঝে এমন কিছু শিক্ষা দিয়ে যায় যেটা কখনোই ভোলা সম্ভব নয়। তবে আপনারা তখনও অনেক ছোট ছিলেন। ছোটবেলায় আমরাও এরকম প্রচুর দুষ্টুমি করেছিলাম তবে আপনার বন্ধু রথীনের সাথে যা হলো তা সত্যি মেনে নেওয়ার মতো নয়। পোস্টটি পড়তে পড়তে চোখের কোন দিয়ে পানি চলে আসলো। এর কারণ আরো একটি রয়েছে, আমারও একটি বন্ধু ছিল এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগে তার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পরে এবং সে পরীক্ষা দেওয়ার আগেই মারা যায়। এতটা খারাপ লেগেছিল যা কখনো হয়তো বলে বোঝাতে পারবো না দাদা। পরিশেষে টিনের পিস্তলটি আপনি পেয়ে গেছেন কিন্তু সেই হারানো বন্ধুত্ব এবং বন্ধু কখনো আর ফিরে আসেনি।
ঘটনাটা বেশ বেদনাদায়ক। খারাপ লাগলো আপনার বন্ধুর কাহিনি টা পড়ে।কখন কার কি হয় বলা যায় না।আসলে ছোটবেলাটাই এমন নতুন কোন খেলনা কেউ কিনলে তার সমবয়সী পিছু পিছু যায়।এখন ও মাঝে মাঝে বাচ্চাদের এমন কাহিনী দেখি। ধন্যবাদ
জীবন বড়ই বিচিত্র। আমার ছোট বেলায়ও আমার এক এলাকার ছেলে যার সাথে আমরা নিয়মিত খেলতাম, বয়সে আমাদের তিন চার বছরের ছোট ছিল, মারা গিয়েছিল। স্কুলে যাওয়ার পথে তার কবরটি পড়তো। তার হাসি মাখা সেই খেলার স্মৃতিগুলো আজও মনে দাগ কেটে আছে। আপনার বন্ধু রথীনের গল্পটি শুনে আজকে সেটি আবারও মনে পড়ে গেল।
ওর মৃত্যুর ৫/৬ মাস পর ওদের পরিবার গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যায় আর কখনো গ্রামে আসতে দেখিনি। এমন বালক বয়সের ছেলেকে হারিয়ে খুব কষ্টেই হয়ত গ্রাম ছেড়েছিল পরিবারটি। পথের প্যাচালীর দুর্গার মৃত্যু আর মার এই খেলার সাথী আষাদের মৃত্যুতে কেদেছি, মনে হলে এখনো হৃদয় ভাড়া ক্রান্ত হয়ে যায় আর নয়নের কোনে অশ্রু চলে আসে।
একটা টিনের পিস্তলের মধ্যে কত স্মৃতি লুকিয়ে রয়েছে। অল্প কয়দিনের বন্ধুত্ব আজও আপনি ভুলতে পারেননি। কিছু কিছু মুহূর্ত এমন ভাবেই অন্তরে গেঁথে থাকে যা কখনো ভুলা যায়না। রথীনের সাথে আপনার বন্ধুত্বটা অল্প দিনের হলেও সেটা খুবই গভীর ছিল। যার ফলে তার করুন চেহারাটি এখনো আপনি ভুলতে পারেননি। ধন্যবাদ দাদা।