উত্তরবঙ্গনামা
বিয়ের বাজারে ছেলের দাম আছে; তবে অবশ্যই চাকুরে হতে হবে। ঢাকায় ব্যাংকের পিয়ন, টি বয় হলেও চলবে। ছেলে কী করে? ব্যাংকে চাকুরী করে। ব্যাস। কেল্লা ফতে। হাইস্কুলের পিয়ন হওয়ার জন্য ৮ লাখ খরচ করতে রাজী, কিন্তু দুই ভাই মিলে ১৬ লাখ টাকায় কোনো ক্রিয়েটিভ বিজনেস করতে নারাজ! সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়ে ছেলেকে পড়ানোই হয় কেবল চাকুরীর উদ্দ্যেশ্যে। যমুনার ওপাড়ের অনার্স-মাস্টার্স পড়ুয়া যেকোনো ছাত্রকে প্রশ্ন করবেন- স্নাতকোত্তর শেষে কী করবেন? সোজা উত্তর- চাকুরী। আমি চাকুরী করাকে নেগেটিভ সেন্সে প্রেজেন্ট করছি না। সংকট হলো, ভালো চাকুরী করতে নিজেকে প্রস্তুত করার সংগ্রামে অনুপস্থিতি। অনেক কাঠখড় পেরিয়ে তপ্ত আগুনে জ্বলে-পুড়ে এসি রুম পাওয়ার প্রচেষ্টার বদলে এক সহজাত হাপিত্যেশ কাজ করে। আমি মাস্টার্স পাশ! রাষ্ট্র আমাকে চাকুরী দিচ্ছে না। উফ! আমার মামা-খালু নাই; তাই চাকুরী নাই। ভুলেও একবার সেলফ জাজমেন্ট করে না। নিজের কোয়ালিটির ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ নাই। এটা বুঝতে চায় না- কোয়ালিটি ছেলেদের চাকুরীর অভাব নাই, এই ২০১৭ সালেও কোয়ালিটি লোকের ক্রাইসিস। সরকারী ও প্রাইভেট- উভয় সেক্টরেই প্রচুর লোকের দরকার। প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কী সে পরিমান কোয়ালিটি অর্জন করেছি? উত্তরবঙ্গের সামাজিক সংস্কৃতি কোনোদিনই উদোক্তা বানাতে দিবে না। গ্রামীণ ব্যাংকের ফিল্ড অফিসার হয়ে কিস্তি তুলে বেড়াতে সমস্যা নাই, সমস্যা হচ্ছে এ ধরণের একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখা। লাখ লাখ টাকা ঘুস দিয়ে কর্মচারী হয়ে বেজায় খুশি। সমস্যা কেবল কয়েকজন মিলে একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোতে। উত্তরবঙ্গ ভালো কর্মচারী সাপ্লায়ার; বস নয়। এটা তেঁতো সত্য। রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন অফিসের বস উত্তরবঙ্গের কেউ খুঁজে পাবেন না; অবশ্য হাজারো কর্মচারীর অভাব হবে না।
উত্তরবঙ্গের মানুষদের ল্যাঙ্গুয়েজ স্কিল নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। ভণিতা না করে সোজাসাপ্টা বললে, উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ মানুষ শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে পারে না। ( আমি নিজেও )। তো? শুদ্ধ বাংলায় কথা না বললে কী সব উল্টে যাবে? জ্বী, উল্টে যাবে। একজন মানুষ যখন আরেকজনের সাথে কথা ট্রান্সফার করে, তখনই তার সম্পর্কে একটা মিনিমাম হিসেব করে নেয়। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা এই কম্পিটিটিভ দুনিয়ায় খুব বেশি দরকারি রে ভাই! আচ্ছা, বাংলা না হয় খুব চেষ্টা করে আয়ত্ব করলাম। আমরা উত্তরবঙ্গবাসী ইংরেজী, আরবীতে কতটা দক্ষ? উত্তর আপনারাই দিয়েন প্লিজ।
উত্তরবঙ্গের সঙ্কট নিয়ে আমি খুব করে ভাবি। উত্তোরণের উপায় খুঁজি। সঙ্কট সমাধানের কাজ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে সঠিক উপায়ে সঙ্কট নির্ণয় করা। আমাকে যদি প্রশ্ন করেন, উত্তরবঙ্গের মূল সঙ্কট কী? আমি সময় না নিয়ে বলবো- প্রথম ও প্রধান সঙ্কট হচ্ছে, উত্তরবঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা।
দেখুন, অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার দরুণ সমগ্র উত্তরবঙ্গের ৮০ শতাংশ মানুষ হ্যান্ড টু মাউথ। বাচ্চাদের জন্য কোয়ালিটি শিক্ষার ব্যবস্থা করা সত্যিই দুরূহ ব্যাপার। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে শিক্ষা যেন বাতুলতা! ২০ শতাংশ পিতা-মাতা তার বাচ্চাদের কোয়ালিটি শিক্ষার ব্যাপারে কনসার্ণ এবং তারা যেকোনো উপায়ে বাচ্চাদের ভালোভাবে পড়াশোনার ব্যাবস্থা করছে। আশার দিক হলো, গ্রামের অনেক বাবা-মা তার সন্তানের সুশিক্ষার জন্য শহরে এসে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। কোয়ালিটি স্কুলে ভর্তি করাচ্ছেন, টিউটর রাখছেন, বাবা-মা নিজে সময় দিচ্ছেন। বাচ্চার ভাষা ও ব্যবহারিক জীবনকে স্মার্ট করে গড়ে তুলছেন। কিন্তু বাঁকি ৮০ শতাংশ ? এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠির সন্তানদের শিক্ষার একমাত্র উপায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে কথা বলতে গেলে শুধু একটা শব্দই মুখ থেকে বের হয়ে আসবে- 'জঘন্য'।
আমি জানি এই 'জঘন্য' শব্দ শুনে অনেকে কষ্ট পাবেন। সবার মত আমিও আমার প্রাইমারী শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি। কিন্তু আজকের এই দিনে এসে আমার উপলব্ধি সরলভাবে উপস্থাপনের কোনো ফাঁকফোকর দেখছি না। আমাকে বলতেই হচ্ছে, প্রাইমারী শিক্ষা ও শিক্ষকদের মান নিয়ে যথেষ্ট কথা বলার স্পেস আছে। গ্রামের একজন শিশু প্রাইমারীতে গিয়েই মূল্যবোধ, স্মার্টনেস, ভাষা, রুচি, সম্মান শিখে। আমি খুব দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, ৯০ শতাংশ স্কুল শিক্ষক শুদ্ধ ভাষা জানে না, ছাত্রদের তুই-তাকারি করে, তাচ্ছিল্য করে। একজন বাচ্চা প্রাইমারী জীবনের প্রথম ৫ বছরেই যখন ঠিকঠাক প্রশিক্ষণ পায় না, তাকে হাইস্কুল-কলেজে এসে র্যাডিক্যাল চেঞ্জ করার ধারণটা মস্ত বড় ভুল। আমি নিজের জীবন থেকেই টের পাই, প্রাইমারীতে আমার বেসিকটা যদি আরো স্ট্রং হতো! প্রাইমারী শিক্ষা নিয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের চিন্তা না করলে সামাজিক পরিবর্তনের লড়াই কোনোদিনই বিজয়ের মুখ দেখবে না- এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন।
আমি বুঝতে পারি না, কেন প্রাইমারী স্কুলের টাইম শিডিউল সকাল ১০.০০ টা থেকে বিকাল ৪.০০ টা পর্যন্ত। এই ৬ ঘন্টায় বাচ্চারা কী পড়ে? আর ৬ ঘন্টায় শিক্ষকবৃন্দ কী পড়ান? শুনেছি অনেক এলাকায় সকাল ৭.০০ টা থেকে ১.০০ টা পর্যন্ত প্রাইমারী আওয়ার। এই সময়টা বাচ্চাদের জন্য বেশি ইফেক্টিভ মনে হয়।
প্রাইমারি শিক্ষা নিয়ে আমার প্রস্তাবনাঃ
- শিক্ষক নিয়োগে যত্নশীল হতে হবে।
- নিয়োগকৃত শিক্ষকদের প্রথমে স্মার্টনেস শিখাতে হবে, ব্যবহারিক জীবন নিয়ে ট্রেইন আপ করতে হবে।
- শিক্ষকদের শুদ্ধ ভাষার কোর্স করাতে হবে।
- স্কুল আওয়ার সকাল থেকে দুপুরের আগেই শেষ করতে হবে।