ধর্মান্ধতা ও মনুষ্যত্ব
না, এটা কোনো প্রবন্ধ না । এই লেখাটি না কোনো উপদেশমূলক, না কোনো ধর্মীয় পোস্ট । এটি নিছকই একটি গল্প । আমার নিজের জীবনের একটি টুকরো ঘটনা । ছোটবেলাকার । গ্রামে থাকতাম তখন । আমার মায়ের এক কাকীমা ছিল । আমাদের ছোট দিদিমা । বুড়ি ভয়ানক সাধু ছিল । গোঁড়া হিন্দু যাকে বলে । গলায় অষ্টপ্রহর তুলসীমালা, কপালে, নাকে, গলায়, বাহুতে, কোমরে, পিঠে সর্বত্র তিলক আঁকা । নিরামিষ স্বপাক আহার আর প্রায় সারাক্ষনই পুজো-আচ্চা নিয়ে থাকা । এই ছিল ছোটদিদার একমাত্র রুটিন ।
বৈষ্ণব ধর্মমতে দীক্ষা নিয়েছিলেন উনি এক সাধুর কাছ থেকে । সারাক্ষন, তাই রাধে-কেষ্ট, রাধে-কেষ্ট করতো । ভয়ানক ছোঁয়াছুঁয়ি ছিল বুড়ির । মামাবাড়ি গেলে স্নান না করে তাঁকে স্পর্শ করা যেত না । মাছ, মাংস খেয়ে এসে ছোঁয়া অসম্ভব ছিল তাঁকে । তাঁর কাছে প্রায় দুনিয়াসুদ্ধ সব কিছুই অশৌচ ছিল । শুধু আমরা বাদে । আমরা নাতিদের একটু বকাবকি করলেও সব কিছুই এলাউ করতো ।
তো, মামাবাড়িতে আমি একটা কুকুর পুষেছিলাম । আমার জীবনে প্রথম পোষা কুকুর ছিল এটিই । আমি যতদিন থাকতাম বেশ আদর যত্ন করতাম কুকুরটার । চলে আসার সময়ে দিদিমাকে বার বার বলে দিয়ে আসতাম যেন ভুলুর যত্ন আত্তি ঠিকঠাক হয় ।
মামাবাড়িতে এই কুকুর পোষা বড় সহজ কাজ ছিল না কিন্তু । একটা রাজ্য জয় করার মতোই কঠিন কাজ এটি । ছোটদিদিমার জন্য মামাবাড়িতে জীবনেও কুকুর পোষা হয়নি । কুকুর অতি অপবিত্র জীব । তাঁর যুক্তি ছিল যে বাড়িতে রাধা-গোবিন্দের মূর্তি আছে সে বাড়িতে কুকুর ঢোকা নিষিদ্ধ ।
আমার এই কুকুর পোষাকে কেন্দ্র করে বিশাল সমস্যা হয়েছিল । কোনোভাবেই ছোটদিদা দেবে না বাড়িতে কুকুর ঢুকাতে । আর আমিও জেদ ধরে বসে থাকলাম । কুকুর পুষবই পুষবো । শেষমেষ আমার জিদেরই জয় হলো । কিন্তু, রাগে ছোটদিদা দুই দিন আমাদের কারো সাথে কথা বলেনি ।
কুকুরকে সর্বদা মূল বাড়ির থেকে কিছুটা দূরেই রাখা হতো বেঁধে । মাঝে মাঝে বাঁধন খুলে দেয়া হতো । কিন্তু, মূল বাড়ির উঠোন অব্দি ছিল তার যাওয়ার সর্বশেষ ঠিকানা । ছোটবেলা থেকে এই শাসনে ভুলু দুটি জিনিস খুব ভালো করে বুঝে গেলো । এক. বাড়ির ভেতরে কোনোদিনও প্রবেশ করা যাবে না আর দুই. ছোটদিদাকে দেখলেই ছুটে বাড়ির দক্ষিণ কোণে বাগানের মধ্যে লুকিয়ে যেতে হবে ।
কারণ, ভুলুকে দেখলেই ছোটদিদা রাগে অন্ধ হয়ে যেত । কুকুরের মতো এত নিকৃষ্ট একটি জীবের ছায়া মাড়াতেও তাঁর তীব্র ঘৃণা বোধ হতো ।
এভাবেই কেটে গেলো দুটি বছর । ভুলু এখন পূর্ণবয়স্ক একটি কুকুর । তাঁর ঘুমানোর স্থায়ী ঠিকানা হলো রান্না ঘরের পাশে একটি কাঠকুটো রাখার জায়গায় । শীতকালে ওখানে বিছানা করে দেয়া হতো । বৃষ্টি পড়লেও ওখানেই গিয়ে আশ্রয় নিতো । বেশ উঁচু জায়গা, জল উঠতো না ।
একবার পুজোর ছুটিতে মামাবাড়ি গিয়েছি । ভুলু আমায় পেয়ে মহা খুশি । সেবার কিন্তু আবহাওয়া মোটেই ভালো ছিল না । বৃষ্টি বাদলা বেজায় । অষ্টমীর দিন ভোর থেকে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো । ঘরবন্দী হয়ে পড়লাম সবাই । সারাদিন ধরে বৃষ্টি হলো । কখনো ঝিরঝিরে, কখনো মুষলধারে ।
বিকেলবেলার পর থেকে বাতাসের তীব্রতা ভয়ানক বেড়ে গেলো । ঘন ঘন বজ্রপাত । আর সেই সাথে তুমুল বৃষ্টি । সন্ধ্যের কিছুটা আগে বাতাসের তীব্রতা বেড়ে ঝড়ের আকার নিলো । আমরা সবাই বারান্দায় খাটের উপরে বসে ঝড় দেখছি এমন সময় কুঁই কুঁই আওয়াজ ।
আর কে ? ভুলু । কখন জানি সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে এসেছে । বেচারার সারা গা ভেজা । থর থর করে কাঁপছে । ওকে দেখেই আমাদের মনে আতঙ্কের সঞ্চার হলো । এখুনি ছোটদিদা আসবে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলে । এসে যদি দেখে ভুলু ঘরে উঠে গিয়েছে তাহলেই হয়েছে আর কি !
আজকে সবার দফা রফা । কুকুর আমার । দায়িত্বও তাই আমার । ছুটে গিয়ে তাড়া দিলাম । নড়লো না । ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে গেলাম । এক বিন্দুও নড়াতে পারলাম না । সমানে কুঁই কুঁই করে যেতে লাগলো । মা ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়ে দাদুর লাঠি বের করলো ।
এমন সময় ছোটদিদা চলে এলো । হাতে সদ্য প্রজ্বলিত সন্ধ্যা প্রদীপ । আমরা ভয়ে একেবারে চিত্রার্পিতের নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ।
আমাদের অবাক বিস্ময়মাখা দৃষ্টির সামনে ছোটদিদা এসে সন্ধ্যা প্রদীপ নিয়ে একটু আরতি করে সেটাকে মাটিতে নামিয়ে আস্তে আস্তে ভুলুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো । আমাকে এক ধমক দিয়ে বললো - "থাক থাক, ওকে তাড়াসনে । এই ঝড় বাদলার রাতে ও কোথায় যাবে বেচারা ?" এই বলে, তার একটা বহু পুরোনো পরনের শাড়ি এনে ঢেকে দিলো ভুলুকে ।
আমরা সেদিন এক অবাক করা ঘটনার সাক্ষী হলাম । ধর্মান্ধতার পরাজয় মানবিকতার কাছে ।