জনসম্পদে ধনী দেশ গরিব থাকতে পারে না
সপ্তাহজুড়ে নানা ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ ও আলোড়ন জেগেছিল। যেমন মিরপুরে বস্তিতে আগুন লেগে হাজার হাজার মানুষের মুহূর্তের মধ্যেই নিঃস্ব হয়ে যাওয়া, কাঠমান্ডুতে বিমান দুর্ঘটনায় অনেকগুলো প্রাণ ঝরে যাওয়া, কলম্বোয় ক্রিকেট খেলায় নাটকীয় হার-জিত এবং সেই সঙ্গে ক্রিকেট জাতীয়তাবাদের উৎকট উত্থান। এর মধ্যে আরেকটি খবর আমাদের জন্য সুবাতাস বয়ে নিয়ে এসেছে নিঃসন্দেহে, তা হলো বাংলাদেশের ‘উন্নয়নশীল’ দেশ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাওয়া।
এত দিন আমরা ছিলাম স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে। অর্থাৎ, পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর একটি হিসেবে আমরা পরিচিত ছিলাম। জাতিসংঘের দেওয়া কিছু সূচকে আমরা স্বল্পোন্নত দেশের চক্করে পড়েছিলাম এত দিন। ২০১৫ সালেই আমরা ওই সূচকগুলো অতিক্রম করে যাই। এ বছর এল আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। তবে পুরোপুরি আনুষ্ঠানিক নয়। এটা নিশ্চিত হবে ২০২১ সালে এবং এরপর আরও তিন বছর আমরা পর্যবেক্ষণে থাকব।
অর্থাৎ, সবকিছু ঠিকঠাক চললে ২০২৪ সালে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাফেলায় বুক চিতিয়ে হাঁটতে পারব।
স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি (লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রি) হিসেবে পরিচিতিতে কোনো মর্যাদা ছিল না। মানুষ হিসেবে বিশ্বসভায় আমরা অনেক ক্ষেত্রেই অপাঙ্ক্তেয়। ভিখারির যতই গুণ থাকুক না কেন, তার সামাজিক মর্যাদা নেই। আমাদের অবস্থা ছিল অনেকটা সে রকমই। আমরা যতই বিশ্বের ‘রোল মডেল’ হিসেবে নিজেদের ঢোল নিজেরা পেটাই না কেন, আমাদের সবুজ পাসপোর্টটা দেখলে অন্য দেশের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের ভ্রু কোঁচকায়। এবার যদি চালচিত্রটা একটু বদলায়।
আমাদের কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকার কথা ছিল না। ছোট জনসংখ্যার দেশ, দ্বীপরাষ্ট্র, চারদিকে ভূমিবেষ্টিত দেশ কিংবা বৈদেশিক দেনার ভারে জর্জরিত দেশগুলোই এ তালিকায় থাকে। জনসংখ্যা যদি ৭৫ মিলিয়ন বা তার বেশি হয়, তাহলে ওই দেশের এই তালিকায় পড়ার কথা নয়-এ রকমই ছিল নিয়ম। ওই নিয়মে বাংলাদেশ পড়ে না। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আমরা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্য হই। তার কয়েক মাসের মাথায় আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় যুক্ত হই। আমরা এটা যেচে হয়েছি, ইচ্ছা করেই। আর্থিক সুবিধা পাওয়ার জন্য অমর্যাদাকর পরিচয়ের এই তিলক পরেছি কপালে। ৪৩ বছর আমাদের এই গ্লানি বয়ে বেড়াতে হলো।
একটি দেশকে জোর করে ভিকারি বানানো যায় না। ঘানা, পাপুয়া নিউগিনি ও জিম্বাবুয়ের আন্তর্জাতিক সূচক অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকার কথা। তারা কিন্তু গরিবদের ওই বর্গে যেতে সব সময়ই অপারগতা জানিয়েছে।
জাতিসংঘের উদ্যোগে ১০ বছর পর স্বল্পোন্নত দেশগুলো নিয়ে শীর্ষ সম্মেলন হয়। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে আমার সুযোগ হয়েছিল গত দুটি শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত থাকার-২০০১ সালে ব্রাসেলসে এবং ২০১১ সালে ইস্তাম্বুলে। স্বল্পোন্নত দেশের একজন নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে কুণ্ঠা হতো। চেয়ে চেয়ে দেখতাম, এশিয়া-আফ্রিকায় স্বল্পোন্নত দেশের কর্তাব্যক্তিরা শীর্ষ সম্মেলনের অনেক অনুষ্ঠানে রীতিমতো এতিমের মতো ঘোরাফেরা করেন। কিন্তু নিজ দেশে তাঁরা প্রচণ্ড ক্ষমতাবান। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যাঁদের অল্পবিস্তর যাতায়াত আছে, তাঁরা জানেন সেখানে আমাদের নিয়ে কত রকম কথাবার্তা, হাসাহাসি হয়। এবার অন্তত ওই বদনামটা ঘোচানোর সুযোগ এসেছে।
অধিক জনসংখ্যার দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় রাখা যায় না-এই যুক্তির পেছনে সারবত্তা আছে। এটা একটা সাধারণ ধারণা যে একটি দেশের বড় সম্পদ হলো তার জনসমষ্টি। জনসম্পদে ধনী একটি দেশ বেশি দিন আর্থিকভাবে গরিব থাকতে পারে না। জনসম্পদের কারণেই চীন আজ বিশ্বের দুই নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি এবং ভারতও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা জনসম্পদের উন্নয়ন ও উৎকর্ষের দিকে ভালোভাবে নজর দিলে অবস্থার আরও ইতিবাচক পরিবর্তন হতো। দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করে আমরা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে আরও বেগবান করতে পারতাম। কিন্তু আমরা সেই পথে হাঁটছি না।
আমরা এখনো যেনতেনভাবে গ্রাম থেকে লোকজন ধরে এনে বিদেশে পাঠিয়ে দিই। আবার দেখা যায়, কাজের সংস্থান না থাকায় অনেকেই দালাল ধরে, অনেক টাকা কর্জ করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, নৌকায় চড়ে বিদেশে পাড়ি জমান। মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে ‘কাজের মানুষ’ পাঠিয়ে আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। অথচ খোঁজ রাখি না, এর ফলে কতগুলো পরিবার অমর্যাদার অন্ধকারে হারিয়ে গেল। জনসম্পদ গড়ে তোলার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকারি যে দুটি জিনিস-শিক্ষা আর স্বাস্থ্যব্যবস্থা-তা আমরা মুনাফাখোরদের হাতে তুলে দিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছি।
আমাদের কাছের দেশ ভিয়েতনাম। এর একটা বড় অংশ মুক্ত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার পর। যুদ্ধে দেশটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তারপরও তারা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির সূচকে ওরা এখন আমাদের চেয়ে এগিয়ে। ওরা খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে নিজেদের এশিয়ার চাল রপ্তানিকারক দেশগুলোর শীর্ষে তিন নম্বরে আনতে পেরেছে। আমাদের কাছে ওরাই তো রোল মডেল হতে পারে। ভিয়েতনাম কিন্তু কখনো স্বল্পোন্নত দেশ হতে চায়নি।
১৯৭১ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় ২৫টি দেশ ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল সিকিম। পরে দেশটি ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়। ২০১১ সালের দিকে স্বল্পোন্নত দেশের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দ্বিগুণ হয়েছিল। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি দিনে দিনে এমন হয়ে উঠেছে যে এখানে অনুন্নয়নের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা বেশ কঠিন। বাংলাদেশের তো লাগল চার দশকেরও বেশি সময়।
এরপরও বাংলাদেশ জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণে থাকবে আরও ছয় বছর। গত ৩০ বছরে মাত্র পাঁচটি দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। এরা হলো বতসোয়ানা (১৯৯৪), কেপভার্দি (২০০৭), মালদ্বীপ (২০১১), সামোয়া (২০১৪) ও গিনি (২০১৭)। এই তালিকায় এখনো ৪৭টি দেশ রয়ে গেছে। এর মধ্যে এশিয়ার দেশগুলো হলো (বাংলাদেশ ছাড়া) আফগানিস্তান, ভুটান, কম্বোডিয়া, পূর্ব তিমুর, লাওস, মিয়ানমার, নেপাল ও ইয়েমেন।
এখানে একটি কথা না বললেই নয়, একটি দেশ উন্নয়নশীল হওয়া মানে এই নয় যে সবাই উন্নয়নের গাড়িতে সওয়ার হতে পারবে। এটা একধরনের গড় অবস্থান। আমাদের দেশে অনেক পরিবার অনেক আগে থেকেই শিল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিকদের মানের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। আবার যুক্তরাষ্ট্রের আছে অনেক গৃহহীন মানুষ। জাতিসংঘের একটি প্রত্যয়নপত্র পেলেই যে দেশে দুধ আর মধুর নহর বয়ে যাবে, এমনটি মনে করার কারণ নেই।
আমাদের দেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। জাতীয় বাজেটের খুব কম অংশই খরচ হয় সামাজিক উন্নয়ন খাতে। আয়বৈষম্য বাড়ছে সমাজে। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার কেন্দ্রীভবন হচ্ছে রাজধানীতে। এগুলোর কোনোটাই সুখকর সংবাদ নয়। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ওপর নজর দেওয়া দরকার। সবচেয়ে বেশি দরকার লাভজনক কর্মসংস্থান তৈরি করা। বাগাড়ম্বর নয়, দরকার পরিকল্পনা এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন। টেস্ট রিলিফ, কাবিখা, ওএমএস-এসব শব্দ মনে করিয়ে দেয় যে দেশে দারিদ্র্য ও সামর্থ্যহীন মানুষের সংখ্যা এখনো যথেষ্ট। বিশ্ব মানচিত্রে আমাদের যে ‘ভিখারি’ পরিচয় তৈরি হয়েছিল, তা দূর করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।