ভালবাসা রকমফের
এবার সমুদ্র হতে দেশে ফেরার কিছুদিন পরের ঘটনা। ড্রাইভার ছেলেটা একদিন এসে মিনতি করল,
- আমার বাসায় কষ্ট করে একদিন আসবেন। দুই মুঠা ভাত খাবেন।
- আরে না, মাথা খারাপ। গতবার তো লজ্জায় ফেলে দিয়েছিলে। তোমার বাসায় যাবার প্রশ্নই আসে না। এমন রান্নাবান্না শুরু কর, কোন মানে হয় না।
- আপনি না আসলে আমি ফ্রিজ খালি করতে পারতেছিনা।
- আরে, অনুমতি না নিয়ে কেনাকাটা করতে কে বলছে?
- আলাদা কিছু কিনি নাই এখনো।
লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে আছে, অর্থাৎ যেতেই হবে।
ফ্যামিলি নিয়ে ওর বাসায় গিয়ে পুরাই হতভম্ব। টেবিল ভর্তি খাবার যার মাঝখানে গরুর মগজ, জিহবা আর কলিজা। ওরা ৩ ভাই মিলে কুরবানি করে। অর্থাৎ নিজের অংশের মাংসের বিনিময়ে সে গরুর ওই বিশেষ ৩ অংশ আমার জন্য গত ৬ মাস ধরে তার ছোট্ট ফ্রিজের ডিপে সংরক্ষণ করেছে। সম্ভবত গাড়িতে আমাদের নিজেদের আলোচনা হতে সে শুনে থাকবে গরুর ওই ৩ অংশের প্রতি আমার দুর্বলতা।
সাথে ছিল মুরগী, মাছ আর কয়েকরকম ফলমূল। বিদায় নিয়ে ফেরার সময় বেঁচে যাওয়া ওই ৩ টা ডিশের বাকিটুকু একটা টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে নিয়ে গাড়িতে তুলে দিল। আমাদের কোন
আমাদের কোনঅনুরোধেই কান দিল না। সে বা তার ফ্যামিলি এই ৩ ডিশ খেতে রাজি না। বাকিটুকুও বাসায় গিয়ে আমাকে খেতে হবে।
এত ভালবাসার ভার সহ্য করা খুব কঠিন। আমার মা আর বউ ছাড়া মনে হয় না আর কেউ এরকম ত্যাগ স্বীকার করবে। অশ্রুসজল চোখে গাড়ি স্টার্ট দিলাম।
গতবারের দাওয়াত পর্ব যারা মিস করেছেন, তাদের জন্য,
গতবছর ও বড়রকমের লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল। ওর বাসায় সপরিবারে দাওয়াত দিয়েছিল। এক বেলা ভাত খাওয়াবে বলে এত বিশাল আয়োজন করে রাখবে জানা ছিল না। ডিনারের আগে নাস্তা - চিকেন ফ্রাই, বিফ রোল, আলু চপ, পুডিং, পিঠা। ডিনারে - চিকেন, মাটন, বিফ, চিংড়ি, মগজ, রুপচান্দা ফ্রাই, ডিম, শুটকি, মিক্সড সবজি, লতি শুটকি, শিং মাছ দিয়ে শিমের বিচি, সালাদ, কোক......... আবার ডিনারের পর আঙ্গুর আর কমলা।অসাধারণ স্বাদের সব আয়োজন। ৫ তারা হোটেলেও এত আতিথেয়তা পেতাম কিনা সন্দেহ। ঠাট্টা করে বললাম, মেয়ের জামাইকেও চাঁটগার মানুষ এত আইটেম দেয় না।
ছেলেটা তার বেতনের অর্ধেক খরচ করে ফেলেছে। ছোট্ট দুই রুমের সংসার, দেয়ালে ইটের গায়ে প্লাস্টার ও নেই। এক রুমে খাট আর অন্য রুমে ডাইনিং / কিচেন। ৫ সদস্যের সংসার। খাটে যারা আঁটে না, কিচেনের পাশে ফ্লোরে ঘুমায়। সত্য কথা হল, ওকে দাওয়াত দিলে ও আমি এত আইটেম রান্না করতাম না। বাসা ছোট হলেও ওর মনটা অনেক বড়।
আমাদের চারপাশে এরকম অনেক মানুষ থাকে, যারা আমাদের নিরবে ভালবাসে কিন্তু আমরা সেগুলা খেয়াল করি না। যদিও এই ভালবাসাগুলা এমনি এমনি অর্জিত হয় না। পরিশ্রমের মূল্য দেয়া, বিপদ আপদে পাশে থাকা আর মানুষের করা আচার ব্যবহারগুলোই ফিরে আসে সুদসমেত। তারপর ও এরকম ভালবাসা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।