রোহিঙ্গা সমস্যায় বাংলাদেশ
রোহিঙ্গা মুসলমানদের সম্পর্কে আপনার যা জানা উচিত
রোহিঙ্গা মুসলমানরা কেন বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত সম্প্রদায়? মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের সঙ্গে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরোধ কোথায়? এই বিরোধ মিমাংসার উপায়ই বা কী? চলুন জেনে নেয়া যাক৷
রোহিঙ্গা কারা?
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের একটি জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়৷ তারা মূলত দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্য রাখাইনে বসবাস করে৷ তবে সে দেশের সরকার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি৷ আর দেশটির সংখ্যাগুরু বৌদ্ধরা তাদের উপর গত কয়েক দশক ধরে নির্যাতন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷
জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যা দিয়েছে৷ প্রতি বছর মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিরাপদ জীবনের আশায় মুসলিমপ্রধান অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করে৷
রোহিঙ্গারা কেন রাষ্ট্রহীন জাতি?
পৃথিবীর রাষ্ট্রহীন মানুষের মধ্যে দশ শতাংশের বাস মিয়ানমারে এবং তারা রোহিঙ্গা৷ জাতিসংঘ ২০১৪ সালে মিয়ানমারের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারকে স্বাগত জানালেও রোহিঙ্গাদের দুর্ভাগ্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে৷ জাতিসংঘ সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো একই রকম নাগরিকত্ব এবং এ সংক্রান্ত সকল সুযোগ-সুবিধা দিতে মিয়ানমারের সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে৷
তবে মিয়ানমারে সরকার এখন পর্যন্ত সেই দাবি মেনে নেয়নি৷ তাদের চোখে, এগারো লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে আসা অভিবাসী৷ এমনকি জাতিসংঘের রেজ্যুলেশনে সংখ্যালঘু এই সম্প্রদায়কে ‘রোহিঙ্গা’ উল্লেখ করায় আপত্তি জানিয়েছে মিয়ানমার৷
অতীতে অবশ্য দেশটি বলেছিল যে, রোহিঙ্গারা নিজেদের বাঙালি হিসেবে স্বীকার করে নিলে তাদের নাগরিকত্ব দিতে দেশটি প্রস্তুত ৷ তবে রোহিঙ্গারা নিজেদের বাঙালি হিসেবে মানতে নারাজ৷
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বাধীন রাখাইন অ্যাডভাইজারি কমিশন গত মাসে ৬৩ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাখাইনে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ইস্যু৷
এই সংঘাত কখন সহিংসতায় রূপ নেয়?
২০১২ সালে বৌদ্ধ এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন প্রাণ হারান৷ তখন বেশ কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়ায় চলে যান৷ গত বছরের অক্টোবরে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালিয়ে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে৷ নিরাপত্তা বাহিনী তখন সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালালে কমপক্ষে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে যান৷ সেই সময় মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছিল বলে জানিয়েছে একাধিক মানবাধিকার সংস্থা৷ রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ এবং তাদের ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগের অনেক অভিযোগও রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে৷
সর্বশেষ সহিংসতার শুরু কখন?
গত ২৫ আগস্ট শ'খানেক সশস্ত্র মুসলমান বিদ্রোহী
মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা চালায়৷ এরপর নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে অসংখ্য রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন এবং ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বলে দাবি করে রোহিঙ্গারা৷ তবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দাবি করেছে, এগুলো রোহিঙ্গাদের সাজানো ঘটনা৷ সহিংসতায় প্রায় চারশ' মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা গেছে৷
জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, সর্বশেষ সহিংসতা শুরুর পর এখন অবধি তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন৷ বাংলাদেশের টেকনাফে বিভিন্ন স্থায়ী, অস্থায়ী ক্যাম্পে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন৷
রোহিঙ্গাদের কি জঙ্গিবাদে উৎসাহ জোগানো হচ্ছে?
মিয়ানমারে বৌদ্ধ এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই সংঘাতের একটি ধর্মীয় দিকও গত কয়েক বছরে আলোচনায় এসেছে৷ গত ডিসেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের যে দল মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের উপর হামলা চালিয়েছে, তাদের সঙ্গে ইসলামপন্থিদের যোগাযোগ রয়েছে৷
২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর প্রতিষ্ঠিত হারাকাহ-আল-ইয়াকিন (হেই) গোষ্ঠী, যারা অক্টোবরের হামলার দায় স্বীকার করেছিল, তাদের সঙ্গে সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের যোগাযোগ রয়েছে বলেও দাবি করেছে আইসিজি৷ ব্রাসেলসভিত্তিক গ্রুপটি জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা অন্যান্য দেশে যুদ্ধ করেছে এবং কিছু আফগান এবং পাকিস্তানি নাগরিক অক্টোবরের সেই হামলার আগে দু'বছর রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল৷
আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’, আল-কায়েদা এবং আফগানিস্তানের তালেবান অতীতে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের নিন্দা জানিয়ে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ এবং বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে জিহাদের আহ্বান জানিয়েছিল৷
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বর্তমানে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা সাত লাখের বেশি৷ মুসলিমপ্রধান দেশটির সরকার, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা কামনা করেছে৷