রবীন্দ্রনাথ কি সত্যি সত্যি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধী করেছেন? আসুন জেনে নেই আসল ঘটনা!
রবীন্দ্রনাথ যদি সত্যি সত্যি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধী হতেন, তাহলে তিনি পারতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে ব্যাহত করতে৷ কিন্তু তিনি তা কখনোই করেননি, করার মতো মানুষও তিনি নন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল আমৃত্যু অটুট বন্ধনের ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর, ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ’, ‘মুসলিম হল ছাত্র সংসদ’, ‘জগন্নাথ হল’, ‘জগন্নাথ কলেজ’, ‘হিন্দু মুসলিম সেবা সংঘ’ এবং ‘ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি’র পক্ষ থেকে ঢাকার নবাব রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনার আমন্ত্রণ জানালে তিনি অবশ্য উপস্থিত হয়ে সংবর্ধনা গ্রহণ করেন। আমন্ত্রণপত্র পাবার পর অধ্যাপক আর সি মজুমদারকে (রমেশচন্দ্র মজুমদার) লেখা একটি পত্রে শ্রদ্ধার সাথে জানান—
‘কল্যাণীয়েষু,
ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করবার জন্যে দূত এসেছিলেন। তাঁদের বিশেষ অনুরোধে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্ব্বেই যাত্রা করতে প্রস্তুত হয়েছি। ৬ই তারিখে রাত্রে রওনা হয়ে গোয়ালন্দ থেকে তাঁদেরই জলযানে ভেসে পড়ব। ১০ই তারিখ পর্যন্ত তাঁদের আতিথ্য ভোগ করে কর্ত্তব্য অন্তে তোমার আশ্রমে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণ পালন করব। নইলে আমাকে দীর্ঘকাল ঢাকায় থাকতে হয়। আমার সময় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃস্থিত ঢাকার লোকের নিমন্ত্রণ কোনোমতেই উপেক্ষা করা উচিত বোধ করিনে। তাই দুই নিমন্ত্রণ ক্ষেত্রে আমার সময়কে বিভক্ত করে দিলুম। যে কয়দিন তোমাদের দেব স্থির করেছিলুম সে কয়দিন সম্পূর্ণই রইল।
ইতি ১৬ মাঘ ১৩৩২ ।
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।’
[ তিনি যদি প্রতিষ্ঠার বিরোধী হতেন তাহলে মাত্র পাঁচ বছর পর এরূপ ‘মহাসংবর্ধনা’ এবং ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ‘ডি.লিট’ উপাধি কি পেতেন? আর তিনিই কি এতটা উৎসাহ নিয়ে যেতেন? ]
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বীকৃতরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে৷ তার এক দশক আগে, ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের দিক থেকে আন্তর্জাতিক মহলে রবীন্দ্রনাথের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে শুরু করে৷ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড হয়ে প্রথম আমেরিকাতে যাবার পরই পাকাপোক্তভাবে নিজের জাত চিনিয়ে আসেন আন্তর্জাতিক মহলে। ১৯১২-তে ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ ‘Song Offerings’ প্রকাশিত হবার পর বিশ্বসাহিত্যে সাড়া ফেলে দেন। ১৯১৩-তে এশিয়ার প্রথম কোনো ব্যক্তি হিসেবে ‘নোবেল’ লরিয়েট ঘোষিত হবার পর বিশ্বমাঝারে রবীন্দ্রনাথের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে যায়।
১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ শাসকদল তাঁকে ‘স্যার’(নাইটহুড) সম্মানিত করে [যদিও ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য এটি বর্জন করেন; তবুও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তাঁকে আজীবন ‘স্যার’ সম্মানেই ডেকেছে] ৷ ১৯১৬, ১৯১৭ —এই সময়গুলোতে জাপান ভ্রমণের মধ্য দিয়ে আমেরিকা জুড়ে তিনি বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান। ইউরোপ-আমেরিকায় তখন তাঁর নিত্য যাতায়াত। সকাল-বিকাল বিশ্বের ক্ষমতাধরদের চায়ের টেবিলে আমন্ত্রিত রবীন্দ্রনাথ৷ তিনি যদি চাইতেন তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে রোধ করে দিতে পারতেন। সেই যোগ্যতা আর ক্ষমতা ছিল রবীন্দ্রনাথের৷ কিন্তু তা করার মতো মানুষ তিনি কখনোই ছিলেন না।
রবীন্দ্রনাথ পশ্চাৎপদ বাঙালি জাতির শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, কৃষি-কৃষ্টি, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন তথা গ্রামোন্নয়ন, বাঙালির আন্তর্জাতিক পরিচয় বিনির্মাণের লক্ষ্যে সারাটাজীবন নিজেকে একজন কর্মী হিসেবে উৎসর্গ করে গেছেন। তিনি শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন ঠিকই, কিন্তু কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করার মতো ঘৃণার্হ কাজ তিনি কখনোই করেননি। রবীন্দ্রনাথ নিজে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকেও বড় কিছু। রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম দেবার ক্ষমতা রাখেন (তিনি প্রতিষ্ঠাও করেছেন ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’) কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় হাজার বছর সাধনা করলেও একটি ‘রবীন্দ্রনাথ’ জন্ম দিতে পারবেন না। সুতরাং, অহেতুক শোনা কথায় ‘কান নিয়েছে চিলে’র মতো হয়ে— বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষাকে নিয়ে কুৎসা রটিয়ে নিজেদের নর্দমায় নামানোর আগে একটু স্টাডি করে নেবেন।
এত সুন্দর করে বুঝিয়ে আমাদের সঠিক বিষয়টি জানানোর জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া 🥰😘😍
Lekha pore bhalo laglo
সুন্দর করে বলেছেন