ভর দুপুরে একজন বৃদ্ধ দোকানে এসে বললেন
ভর দুপুরে একজন বৃদ্ধ দোকানে এসে বললেন, 'একটা কেক দাও তো মিয়া ভাই!' দুপুরটা রোদে খঁ-খাঁ করছে। এমন ভর দুপুরে একটা মানুষ কেক খাবে? ব্যাপারটা খটকা লাগল! সহজ কঠিন সব ব্যাপারেই পুলিশের খটকা লাগে! এটা স্বাভাবিক!
'চাচা মিয়া, দুপুরবেলা কেক খান ক্যান?'
'বাবারে, হোটেলে খাওনের ট্যাহা নাই! কেকটা খায়া প্যাট ঠাণ্ডা করি!'
'প্রতিদিন খান কই?'
'বাড়িতে! কিন্তু দুপুরে যাওন যায় না।
মালিকের হুকুম। আধাঘণ্টার মইধ্যে দুপুরের খাওন শ্যাষ করন লাগব! ইট ভাটার কাম খুব কড়া! বেশি কড়া ভাটার মালিক!'
'তো বাড়িতে খেয়ে আসেন!'
'নারে বাপ! যাইতে-আইতে রিকশাভাড়া লাগে। আবার আধাঘণ্টায় কুলানো যায় না!'
আমি আশ্চর্য হলাম। এভাবে একটি বৃদ্ধ কাজ করবে অথচ দুপুরে কেক দিয়ে পেট ঠাণ্ডা করবে- বিষয়টি অদ্ভুত! একটু আগেই আমি খেয়েছি। বৈষম্যের প্রাচীর ভেদ করে খাবারটুকু পেট থেকে বমি হয়ে বের হতে চাইছে!
বললাম, 'চাচা চলেন আমার সাথে!'
তিনি ভয় পেয়ে গেলেন! ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বললেন, 'স্যার কই নিয়া যাবেন?'
আমি বললাম, 'স্যার বলতে হবে না! আমি আপনার সন্তানের মতো। চলেন!'
রেস্টুরেন্টে লোকজন ভর্তি! পাশ থেকে একজন বলছে, 'শালার পুলিশের ধর্ম নাই! বুড়া লোকটারে নিয়া যায় কই?' আমি শুনলাম। না জেনে হুটহাট করে মন্তব্য করা একদল মানুষ আছে! এরা এই দলের। মাথা গরম করলাম না। ছোটখাট বিষয়ে মাথা গরম করা পুলিশের বৈশিষ্ট্য না।
হোটেলের এক কোণায় বৃদ্ধ চাচাকে বসালাম। চাচা ভয়াবহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এতটা অবাক হয়তো জীবনে কখনো হননি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, গরু খাবেন না মুরগি?
গরুর কালা ভুনা। সাথে শসার সালাদ। লেবুর টুকরাকে চিপে চিপে সব রস বের করে দুই প্লেট ভাত খেলেন বৃদ্ধ! আমি মুগ্ধ হয়ে তার খাওয়া দেখছি! পৃথিবীতে এত সুন্দর দৃশ্যও থাকতে পারে।
হোটেলের ম্যানেজার আসলেন। বললেন, স্যার কোল্ড ড্রিংস দিব? আরসি? সেভেন আপ? আমি জবাব দিলাম না। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজাররা সাধারণত ক্যাশ টেবিল ছেড়ে একচুলও এদিক-ওদিক হন না। আর তিনি আমার কাছে এসে সেভেন আপ অফার দিচ্ছেন! ব্যাপারটা আমার কাছে খটকা লাগল! ছোটখাটো ব্যাপারও পুলিশের কাছে খটকা লাগে! এটা স্বভাবিক!
আমার নিরুত্তর থাকা তাকে চলে যেতে বাধ্য করল। হয়তো-বা আরো কিছুক্ষণ থাকত। ক্যাশে টাকা দিতে গিয়ে বাঁধল বিপত্তি! ম্যানেজার আমার টাকা নেবেন না! আশ্চর্য তো! জানতে চাইলাম টাকা নেবেন না কেন? ম্যানেজার খুব গুছিয়ে কথা বললেন, 'সেবাই মানুষের ধর্ম! তো আপনি একাই সেবা করে ধর্ম করবেন, আমি করব না?'
বললাম, বুঝিনি! সোজা বাংলা ভাষায় কথা বলো! পেঁচিয়ে কথা বলার জন্য বায়ান্নতে রক্ত দেয়নি জব্বার-রফিকরা! ম্যানেজার সহজ ভাষায় বললেন, বৃদ্ধ চাচাকে আপনি খাওয়াতে নিয়ে এসেছেন। সুন্দর কাজ। এবার আপনার সুন্দর কাজে আমিও যোগ দিলাম। দেড় শ টাকা বিল নেব না। হোটেল মালিককে আমি টাকাটা দিয়ে দেব।
আমি বললাম, তা কি করে হয়? আমি এনেছি!
ম্যানেজার বললেন, আমাকে কি তাহলে ভালো কাজ করার সুযোগ দেবেন না?
এবার আমি হেরে গেলাম। কিছু হার মধুর! আনন্দের! হেরে গেলে জিতে যায় মানবতা! একটি সুন্দর কাজ আর একটি সুন্দর কাজের জন্ম দেয়! রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলাম একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। পৃথিবীটা আরো কিছু দিন বেঁচে থাকুক। হাজার কোটি বছর টিকে আছে এদের মতো ভালো মানুষগুলোর জন্যই! এই মানুষগুলোর পায়ের স্পর্শ আছে বলেই, মনে হয় পৃথিবীটা অবিরাম ঘুরছে। তা না হলে, এত বড় সূর্যের চার পাশে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে যেত।
বৃদ্ধ চাচাকে তার কর্মক্ষেত্রে ফিরতে হবে। ভরপেটে খেয়ে এই ভরদুপুরে হেঁটে গেলে তিনি কাজ করতে পারবেন না। একটা রিকশা ডাকলাম। ভাবলাম, একটু দরকষাকষি করে দশ-বিশ টাকায় রিকশাটা ম্যানেজ করে দিই!
রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাড়া কত? রিকশাওয়ালা যা জবাব দিল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। সে জানাল, ভাড়া লাগব না স্যার! বুড়া মানুষ যাইব! আমি ভাড়া নিমু না, স্যার! বহুত কামাই করছি! মনে হলো অদৃশ্য কেউ একজন আমার শার্টের কলার চেপে ধরে গালে একটা চটাস করে থাপ্পড় দিয়ে শাসাচ্ছে; ব্যাটা ভাড়া কমানোর জন্য দরকষাকষির চিন্তা করিস? মানুষ চিনলি না?
চিলের মতো ছোঁ মেরে রিকশাওয়ালা বৃদ্ধাকে নিয়ে গেল! রিকশা চলছে! চলন্ত চাকার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। এই মহান মানুষগুলোর পায়ের স্পর্শে এই পৃথিবীটা রিকশার চাকার মতো ঘুরছে। মনে হলো মানুষ মরে যাচ্ছে; মানবতা বেঁচে আছে। হিসেবের খাতা খুলে হিসেব করলাম, একটি সুন্দর কাজ দুটি সুন্দর কাজের জন্ম দেয়! আমি ইট ভাটার মালিককে ফোন দিলাম। থানার দারোগা পরিচয় দিয়ে বললাম, আপনার ইট ভাটার শ্রমিকদের দুপুরে খাবার সময় কম দেন কেন? বেতনও নাকি কম দেন?
'স্যার! স্যার!'
'আরে মিয়া স্যার স্যার করেন কেন?'
'জ্বি স্যার! জ্বী স্যার!'
'ভাটার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেব?'
'না স্যার! না স্যার! দেইখেন কালকেই সব ঠিকঠাক করে দিব!'
আমি ফোন রেখে দিলাম। খুব অল্প সময়ে খুব অল্প চেষ্টায় কিছু কিছু অধিকার এনে দিতে পারি।
Congratulations @sohelrana44! You have received a personal award!
1 Year on Steemit
Click on the badge to view your Board of Honor.
Do not miss the last post from @steemitboard:
Congratulations @sohelrana44! You received a personal award!
You can view your badges on your Steem Board and compare to others on the Steem Ranking
Vote for @Steemitboard as a witness to get one more award and increased upvotes!