পর্ব - ৪ ( শেষ পর্ব ) ★ আলোকচিত্রের অলৌকিক ছায়া★ [ ১০% shy-fox ভাই এর জন্য ]

in আমার বাংলা ব্লগ2 years ago (edited)

image.png

image source

★★★★★ আলোকচিত্রের অলৌকিক ছায়া ★★★★★

চতুর্থ পর্ব

তৃতীয় পর্বের লিঙ্ক

source

*************

আর দেখতে পারে না সুদীপ্ত। তার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। আসলে সে এসবে অভ্যস্ত নয়। সে প্রাকৃতিক ছবি তুলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। প্রকৃতির সৌন্দর্যের আড়ালে যে এমন ভয়ংকর পৈশাচিক বাস্তবতাও লুকিয়ে আছে। তা সে কল্পনাও করতে পারে নি। যাই হোক। ভিডিও দেখতে গিয়ে মানসিক ভাবে বিদ্ধস্ত হলেও, সুদীপ্ত নিজের প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে। তার দেহে ঋণাত্মকতার অস্তিত্ব সময় বিশেষে প্রভাবশালী থাকায়, অনুপের কেসটায় সেই অযাচিত সাফল্য এসেছিল।

তার এই ব্যাপারটা আরেকবার যাচাই করা প্রয়োজন। তার পাড়ার পরিচিত জনৈক ভদ্রলোক, শ্রী প্রদোষকে সেনগুপ্ত। ওনারা এপাড়ায় নতুন এসেছেন। বদ্যি বলে তার পরিবারের সাথে বেশ ভালো আলাপ হয়েছে। তো সেই ভদ্রলোককে এই ফটোগ্রাফির কথা বলায়, তিনি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। সুদীপ্তর হাত চেপে ধরে বলেন,
" বাবা সুদীপ্ত! তুমি সত্যি বলছ বাবা? এমন ক্যামেরা আছে তোমার কাছে? তুমি আমার মেয়েটার একটা ঝলক আমাকে একটু দেখাতে পারবেব? কতদিন দেখিনি আমার মা টাকে" ছল-ছল করে ওঠে প্রদোষ কাকাবাবুর চোখ দুটি।

সুদীপ্ত জানতে চায়, "আচ্ছা কাকাবাবু, কি করে মারা গিয়েছিল সে? " প্রদোষ বাবু বলেন, " তুমি তো জানো সুদীপ্ত, আমরা সবেমাত্র এ পাড়ায় এসেছি। এর আগে আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে, আমি আমার স্ত্রী ও সাত বছরের মেয়ে মিলিকে নিয়ে, শান্তিতেই ছিলাম। সে সুখ কপালে সইল না। ছাদে খেলতে গিয়ে মেয়ে টা আমার..... কথা শেষ করতে পারেন না প্রদোষকে বাবু। তার দুচোখ দিয়ে অঝোরে ঝরছে অশ্রুধারা।

প্রদোষ বাবু আর তার স্ত্রীর একটি ছবি তুলেছিল সুদীপ্ত। তারপর সেই ছবি নিয়ে ঢুকে পড়েছিল সে, নিজের ল্যাবে। তখন মধ্যরাত। আজ এখনো বাড়ি ফেরেনি শেখর। মা ফোন করেছিল। সুদীপ্তর স্বাস্থের প্রতি দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে বলেন, " বাবু! সারাদিন এমন ফোটোগ্রাফির কাজ নিয়ে মেতে থাকলে চলবে? শরীরের দিকেও তো নজর দিতে হবে। খাবি কখন? "

সুদীপ্ত বলেছে, " মা আমি খাবার অর্ডার করে নিয়েছি। আসলে একয়া ভীষণ দরকারী কাজ রয়েছে হাতে। সেটা শেষ৷ না হওয়া অবধি শান্তি পাচ্ছিনে একদম! "

দুটো বেজে ত্রিশ মিনিটে প্রথম ডেভেলপ হওয়ার পর ভয়ে ভয়ে ছবিটার দিকে তাকালো সুদীপ্ত। কি আশ্চর্য !!! সত্যিই তো, দেখা যাচ্ছে বছর সাতেকের একটি ফুটফুটে মেয়ে, মাথায় এক রাশ চুল, হ্যাট পরেছে, মিস্টি নিরিহ হাসি মুখে তাকিয়ে রয়েছে নিস্পলক দৃষ্টিতে। আরও বেশ কয়েকবার ভালো ভাবে ডেভেলপ করার পরে একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠল মেয়েটির ছবি। বাবা মা এর মাঝখানে চুপটি করে বসে আছে মিলি।
ছবিটা দেখে এখন সুদীপ্তরও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, এই ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটি আজ কয়েক বছর হল পৃথিবীতেই নেই। অজান্তে সুদীপ্তরও বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।কেন জানি না চোখ ভরে উঠল, নোনা জলে। কন্যা হারা পিতা ও পরিবার হারা কন্যার মিলিত শোকের, অনিয়ন্ত্রিত বেদনা যেন সুদীপ্তকে তার পারলৌকিক মাধ্যম হবার পুরস্কার স্বরুপ কাঁটার মুকুট পরিয়ে দিল।

পরদিন দুপুর দুটো নাগাদ এই ছবির কপি নিয়ে সুদীপ্ত পৌঁছেছিল প্রদোষ বাবুদের বাড়িতে। চরম বিস্ময়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন প্রদোষ বাবু ও তার স্ত্রী মনোরমা দেবী। একদিকে প্রাণের চেয়েও প্রিয় মেয়ের মুখটা আবার দু-চোখের দেখা দেখতে পাওয়ার আনন্দ! অপর দিকে মেয়েকে ফিরে না পাওয়ার, মরণের চেয়েও গভীর শোক।

কান্নায় ভেঙে পরলেন স্বামী স্ত্রী দুজনই। তারই মাঝে প্রদোষ বাবু এসে সুদীপ্তর হাতে একটা পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে বলেছিলেন - “ সুদীপ্ত ! তুমি যে আমার কি উপকার করলে ভাই.... তা তুমি নিজেও জানো না। আমি জানি, এই উপকারের প্রতিদান টাকা দিয়ে সম্ভব না, তবুও ভাই তুমি এই পাঁচশো টি টাকা রাখো। দয়া করে না কোরোনা।” “আমার মেয়ে কবে হারিয়ে গেছে বলতো, সত্যি কথা বলতে কি..আমার সোনা মা টার একটাও ভালো ছবি ছিল আমাদের কাছে। ওর চলে যাওয়ার এত দিন বাদে, এই প্রথম বোধহয় তাকে এতো কাছ থেকে দেখতে পাবো আমরা।”

কন্যা হারা শোকার্ত দম্পতিকে সেই অবস্থায় রেখে বেরিয়ে এসেছিল সুদীপ্ত, ফিরে এসেছিল তার স্টুডিওতে। স্টুডিওর সামনে ছোট করে একটি বিজ্ঞাপন টাঙিয়ে দিয়েছিল সে। তাতে লিখেছিল- “ আপনাদের পরিবারের কেউ কি মারা গেছেন অপঘাতে? যদি ফটোগ্রাফির মাধ্যমে সেই মৃত আত্মার ছবি ফুটিয়ে তুলতে চান? তাহলে আসুন। এখানে সেই ব্যাবস্থা আছে।

এখন মাঝে মধ্যেই তার এখানে এমন উদ্ভ্রান্ত কিছু মানুষের ভিড় জমে। কারো বাবা, কারো মা, কারো সন্তান কারো স্বামী মারা গেছেন অপঘাতে- আগুন লেগে, সন্ত্রাসবাদী হানায়, অ্যাকসিডেন্টে, ল্যান্ড-স্লাইডে আরও কত কি। কতরকম যে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এই পৃথিবীতে, আগে এসবের খবর রাখত না, সুদীপ্ত দাশগুপ্ত। এসব বিষয়ে চর্চা করতে করতে আজকাল নিজেকে কেমন যেন মৃত্যুর দূত মনে হয়।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, সুদীপ্ত দাশগুপ্ত আর কোন সাধারণ ফটোগ্রাফার নন। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে সুদীপ্ত দাশগুপ্ত একজন জনপ্রিয় প্যারানর্মাল ফটোগ্রাফার অ্যান্ড ইনভেস্টিগেটিং স্পেশালিষ্ট । বড় বড় ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে ওর লেখা প্রকাশিত হয়। সে নিজের একটি সংস্থা খুলেছে, ইন্ডিয়ান প্যারানর্মাল ফটোগ্রাফি অ্যান্ড ইনভেস্টিগেটিং সোসাইটি।

টাকা পয়সার অভাব তার নেই। তবে মাঝে মাঝে একলা বিকেলে বাড়ির ব্যলকনিতে বসে সে নিজেকে প্রশ্ন করে, " তবে আমাকে কি মানুষ মনে রাখবে একজন, মৃত আত্মার মাধ্যম হিসেবে? আমার যে সাধনা ছিল, স্বপ্ন ছিল ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফি ফেস্টিভ্যাল এ যোগ দেবো, পৃথিবীর অন্যতম দক্ষ ওয়াইল্ড লাইফ ফটো গ্রাফার হবো, আমার তোলা ছবি ছিনিয়ে আনবে শ্রেষ্ঠত্বের সন্মান। সেই স্বপ্ন কি চিরদিনই না দেখা থেকে যাবে আমার? ” আজ সুদীপ্তের অস্তিত্বের চারপাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে অশরীরী অতীতের মিছিল। সেই ভীড় থেকে ভেসে আসছে তাদের সন্মিলিত কন্ঠস্বর। তারা বলছে-
“ সুদীপ্ত, তোমার স্বপ্ন কোনদিন সফল হবে না। তুমি এভাবেই মৃত অতীতের সন্ধানে ব্যস্ত থাকবে আজীবন। এভাবেই তোমার আত্মার মুক্তি লাভ ঘটবে। তোমার হৃদয় পাবে কাঙ্ক্ষিত পরিসমাপ্তি।

( সমাপ্ত )

Coin Marketplace

STEEM 0.17
TRX 0.13
JST 0.030
BTC 56577.01
ETH 2981.05
USDT 1.00
SBD 2.14