|| সুন্দরী ও গোলপাতা গাছের নামকরণের রহস্য উদ্ধার ||
গোল-পাতা গাছের পাতাগুলো সত্যই কি গোল? সুন্দরী গাছ কি আদেও সুন্দরী? যদি তা না হয় তবে কেনই বা এমন নামকরণ?
সুন্দরবনের এই দুই বিখ্যাত গাছের রহস্য উদ্ধার হবে আজকের পোস্ট-এ।
গোলপাতা গাছ
সজনেখালি টাইগার রিসার্ভ এরিয়ায় যখন আমাদের বোট এসে থামলো তখন বেশ কয়েকটি অভিজ্ঞতায় হলো আমাদের। এখানে সুন্দরবনের লুপ্ত প্রায় সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদের একরকম যত্ন নিয়ে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। তার মধ্যে একটি লুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ হল গোলপাতা গাছ। সুন্দরবনের এই নামকরা গাছটি লুপ্তপ্রায় হতে চলেছে। আরো বহু গাছ রয়েছে যাদের আমরা চিনি না। বইয়ের পাতায় সমস্ত কিছুই তো আর ওঠানো হয় না। তাই আমরা অনেক গাছ পালার নাম এখনো জানিনা।
আমাদের ট্রাভেল-গাইড বিভিন্ন প্রজাতির গাছ আমাদের দেখালেন যেগুলোর নাম পূর্বে কখনোই শুনিনি। তিনি বললেন সুন্দরবনে চৌষট্টি প্রজাতির গাছ রয়েছে। এর মধ্যে বহু গাছ লুপ্তপ্রায় হতে চলেছে। আমরা দেখলাম গোলপাতা গাছ।
এই গোল-পাতা গাছের নাম বহুবার ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি। গোলপাতা গাছ সুন্দরবনের এক ঐতিহ্যবাহী গাছগুলোর মধ্যে একটি। তবে এখন এটি বিলুপ্তের পথে। গোলপাতা গাছ অনেকটা খেজুর গাছের মতো। তবে গাছের গোড়া একেবারে অন্যরকম যা কখনোই দেখিনি। এই গাছের মাথায় নয়, গাছের গোড়াতেই ফুটবলের মত একরকম ফল ধরে। ফুটবলের গা মসৃণ থাকে কিন্তু এই ফলে বড় বড় কাটার মত মোটা গম্বুজাকৃতি এক রকম শ্বাস বেরিয়ে থাকে।
সুন্দরবনে এক সময় এই গোলপাতা গাছ অধিক পরিমাণে ছিল। এখন একেবারেই কমে গেছে। এই টাইগার রিজার্ভ এরিয়ায় গাছটির বেশ কিছু পরিমাণ সংরক্ষণে রাখা হয়েছে। তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা এই গাছগুলোয় কাউকে হাত দিতে দেওয়া হয় না।
সুন্দরবন টাইগার রিসার্ভ এরিয়া
গোলপাতা গাছ অনেক উপকারী তা ট্রাভেল-গাইডের মুখ থেকে আমরা জানতে পারলাম। ট্রাভেল গাইডটি সুন্দরবনের পাখিরালয় গ্রামের একজন শিক্ষিত যুবক। চোখের সামনে তিনি সমস্ত কিছুই দেখেছেন। জেনেছেন। তাই তার এই সমস্ত বিষয়ে খুবই ভালো ধারণা রয়েছে।
ট্রাভেল গাইডের কথা অনুযায়ী, গোলপাতা গাছের পাতার গোড়ার সাঁস থেকে নির্গত একরকম রস পাওয়া যায় যা থেকে মধু, গুড় তৈরি করা যায়। এক সময় যখন গোলপাতা গাছ অধিক পরিমাণে সুন্দরবনের মধ্যে ছিল তখন মানুষ এই সাঁস থেকে রস নিয়ে মধু, গুড় ও নানান ঔষধি জিনিস তৈরি করত।
ছোটবেলা থেকেই আমি মনে করতাম গোলপাতা গাছ মানে এর পাতাগুলো গোলাকার কিন্তু মোটেই তা নয়। এর পাতাগুলো একেবারেই খেজুর গাছের মতো আকৃতি ও আকারে। এই গাছের গোড়ায় ধরে থাকা ফলগুলোর গোল গঠন থেকেই বরং গাছটির এমন নামকরণ হয়েছে।
সুন্দরী গাছ
ছোটবেলায় সুন্দরী গাছের নাম শুনে আমরা আকাশ কুসুম ভাবতাম। মনে করতাম সুন্দরী গাছ হয়ত সৌন্দর্যে ভরপুর। কিন্তু সুন্দরবনে এসে সুন্দরী গাছ দেখার পর আমার ভুল ভাঙলো। এই গাছটি মোটেই সৌন্দর্যে ভরপুর নয়। একেবারেই সাদামাটা একটি গাছ। আমাদের এলাকায় অনেক গাছ দেখতে পাওয়া যায় যা ভীষণ সুন্দর।
তবে সুন্দরী গাছের কিছু সুন্দর দিক রয়েছে যা এই গাছের নামকরণকে সার্থক করে তোলে। সুন্দরী গাছের কাঠ খুবই শক্ত হয়। এই গাছ থেকে তৈরি ফার্নিচার খুবই টেকসই ও মজবুত। তাই বাজারে সুন্দরী গাছের কাঠের এত দাম এবং এ কাঠ সহজে বাজারে মেলেনা।
সুন্দরী গাছের মূলগুলো শ্বাস নেওয়ার জন্য মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে এসে উপরের দিকে মুখ করে থাকে। এগুলোকে শ্বাসমূল বলে। এই শ্বাসমূল গুলোকে হাত ও পায়ের ঠেলা দিয়ে একটু বাঁকানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু এগুলো এতটাই শক্ত যে একবিন্দু পর্যন্ত নড়াতে পারলাম না। শুধু আমি নয়, আমার সাথে আরো যারা পর্যটক গিয়েছিলেন তারাও সর্বশক্তি দিয়ে ওই ছোট্ট শ্বাসমূল গুলোকে একটু নাড়াবার চেষ্টা করলেন কিন্তু কেউই পারলেন না। সুন্দরী গাছের এই কাঠিন্য সবাইকে অবাক করেছে।
সুন্দরী গাছের শ্বাসমূলের শর-শয্যা
এক-বোট যাত্রী আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতা নিয়ে পুনরায় বোটে উঠলাম। কিন্তু এখানেই আশ্চর্যের সমাপ্তি নয় সেটা বোট ছাড়ার ঘণ্টা দুয়েক পরেই বুঝতে পারলাম গভীর জঙ্গলে এসে। দোবাঁকি ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে তখন বোট ছেড়েছে। ক্যাম্পটি সুন্দরবনের গভীর অরণ্যের মধ্যে রয়েছে। সোনাখালী থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটারের পথ দোবাঁকি ক্যাম্প।
কিন্ত ক্যাম্পে পৌছানোর আগেই নদীর পাশে সুন্দরী গাছের যে শ্বাসমূল দেখলাম তা আরো ভয়াবহ। এই গভীর অরণ্যের সুন্দরী গাছগুলোর শ্বাসমূল হাঁটু সমান উঁচু আর গরুর শিং এর মত সূচালো। এই ভয়াবহ শ্বাসমূলগুলো ঘন আকারে বিস্তৃত রয়েছে। এখানেই বেশিরভাগ বাঘ থাকে বলে ট্রাভেল গাইড আমাদের অবগত করলেন।
তার মুখ থেকে এটাও শুনে অবাক হলাম যে এ ঘন শ্বাসমূলের মাঝে বাঘ ছোটাছুটি করে, স্বীকার করে কিন্তু কোনভাবেই তার পা এগুলোই বেধে যায় না বা এর উপর পা পড়ে না, ঠিক যে অংশটুকুই মাটি রয়েছে সেখানে বাঘের পা পড়ে।
এটা জেনে আমরা সবাই একরকম চমকেই উঠলাম। বুঝতে পারলাম এভাবেই এডাপটেশন এর মাধ্যমে একটা খাদ্যশৃংখল তৈরি হয়। এও বুঝতে বাকি রইলো না যে একটা খাদ্যশৃঙ্খল তৈরি হওয়া সহজ নয়। বহু সময় লাগে। নানান হিসেব-নিকেশ রয়েছে।
তিনি এও জানালেন বাঘ যখন শিকার করে তখন এই শর-শয্যার উপর দিয়েই শিকারকে টেনে নিয়ে যায়। বাঘের মুখে মৃত্যু না হলেও এই ছুরি-বিছানার উপর টেনে নিয়ে যাওয়ার সময়ই যে শিকারের মৃত্যু অবধারিত তা আমরা সকলে বুঝতে পারলাম।
সুন্দরবন,
পশ্চিমবঙ্গ
ক্যামেরা - iQoo 9se
মডেল - 12019
ফোকাস লেংথ - 25mm
আজ এই অব্দি রইল। আগামীকাল আবার নতুন কিছু কথা নতুন একটি লেখা নিয়ে হাজির হব। ততক্ষণ আপনারা ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ।
হ্যা বাংলাদেশের বেশ কিছু জায়গা এখন গোলপাতা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করা হয়। এবং এই গুড় নাকী অনেক সুস্বাদু। সুন্দরী গাছ দেখলেও গোলপাতা গাছ কখনো দেখিনি। একেবারে তথ্যবহুল একটি পোস্ট ছিল ভাই। ধন্যবাদ আপনাকে।
হ্যাঁ এই গুড় নাকি সুস্বাদু। ধন্যবাদ দাদা সুন্দর মন্তব্য করে পাশে থাকার জন্য।
সুন্দরী এবং গোলপাতার নিয়ে খুবই সুন্দর আলোচনা করেছেন তথ্যবহুল।। আমিও এটা শুনেছি যে সুন্দরী গাছের রস থেকে গুড় প্রস্তুত করা যায় খেতেও নাকি দারুন মজাদার।। তবে মজার বিষয় হচ্ছে গোলপাতা আমি আগে ভাবতাম পাতাগুলো মনে হয় সত্যি সত্যি গোলাকার এবং বড় বড়। তবে যখন আমি ২০১৫ সালের সুন্দরবন ভ্রমণ করেছিলাম তখন বুঝতে পারলাম না নাম গোল পাতা কিন্তু পাতাগুলা নারিকেলের পাতার মতই।।
আমারও একই ভাবনা ছিল। যাইহোক ভ্রম ভেঙেছে। ধন্যবাদ মন্তব্য রাখার জন্য।
পরিকল্পনা চলছে খুব শীঘ্রই সুন্দরবন ভ্রমণ করতে যাব বন্ধুদের সাথে।।
সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ, গোলপাতা এগুলো আসলেই আমরা পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি। এর নামকরণ সহ নানা তথ্য উপাত্ত পেলাম আপনার কাছে সুন্দরবনের। চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন আপনি আপনার সুন্দরবন ট্রাভেলিং। আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইল।
হ্যাঁ দাদা ছোটবেলায় অনেক পড়েছি এসব নিয়ে। কাছে গিয়ে অভিজ্ঞতা টা আরো সুন্দর হলো। মন্তব্য রাখার জন্য অনেক ধন্যবাদ দাদা।
ভাইয়া খুবই তথ্যবহুল একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন আপনি। আপনার পোস্টটি পড়ে আমার খুবই ভালো লেগেছে। বিশেষ করে সুন্দরী গাছের বিষয় নিয়ে লেখাগুলো অতি চমৎকার ছিল। আর আমিও অনেক আগেই শুনেছি অনেক আগেই শুনেছি যে গোলপাতা গাছ থেকে রস দিয়ে গুড় তৈরি হচ্ছে তবে এ ধরনের গুড় খাওয়ার সুযোগ এখনো আমি পাইনি। অসাধারণ একটি পোস্ট শেয়ার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ভালো লাগলো আপনার কথা শুনে। সুন্দর একখানা মন্তব্য করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।