নজরুল জয়ন্তী
Copyright Free Image Source : banglapedia
আজ নজরুল জয়ন্তী । ১৮৯৯ সালের ২৫ শে মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন । গ্রামের নাম চুরুলিয়া । এই চুরুলিয়ায় এ বছর বেশ ধুমধামের সহিত কবির ১২৫ তম জন্মদিবস পালন করা হলো । কবি নজরুল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধারায় কাব্যরচনা করে রবীন্দ্রযুগে থেকেও রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত কাব্য ও সাহিত্যচর্চা করে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রযুগে রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত সাহিত্য চর্চা বেশ কঠিন ছিল, অল্প কয়েকজন কবি এবং সাহিত্যিকই এই যুগে সাহিত্য চর্চায় স্বতন্ত্র ধারা বজায় রাখতে পেরেছিলেন ।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী । কাব্য, গদ্য, প্রবন্ধ ছাড়াও প্রচুর সঙ্গীত লিখে গিয়েছেন ও তাতে নিজের করা সুর আরোপিত করে গিয়েছেন । এছাড়াও তাঁর রচনা করা বহু নাটকের গান (বিশেষ করে লোটো গান) দারুণভাবে সমাদৃত ছিল সে আমলে । কবি নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, ছোট-গল্পকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক, সম্পাদক, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, সাংবাদিক, অভিনেতা এবং সেনাবাহিনীর সদস্য ।
কিন্তু, তাঁর সবচাইতে বড় পরিচয় তিনি ভারতের একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী । তাঁর কবিতায়, আবৃত্তিতে, গানে বারবার তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন । তাঁর বিদ্রোহী কবিতার ছত্রে ছত্রে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান রয়েছে ।
"আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!
আমি দুর্ব্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল!
আমি মানি নাকো কোনো আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম,
ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
আমি বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
বল বীর —
চির উন্নত মম শির!"
"মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না –
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর —
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!"
কবিতার লাইনগুলো পাঠ করলেই বোঝা যায় ব্রিটিশ সিংহের ভয় পাওয়ার কারণ কী ! তৎকালীন সময়ে এই কবিতাটি যেখানেই পাওয়া যেত - তা সে যে পুস্তিকা বা পত্রিকাই হোক না কেন ব্রিটিশরা জব্দ করে পুড়িয়ে ফেলতো । এই কবিতার জন্য কবি পরবর্তীতে জেলও খেটেছেন একাধিকবার ।
জেলে গিয়েও তাঁর লেখনী রুদ্ধ হয়নি । জেলে বসেও রচনা করে গিয়েছেন একের পর এক বিস্ফোরক সব কবিতা যেগুলো ব্রিটিশদের শাসন-ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলো ।
"কারার ঐ লৌহ-কপাট
ভেঙ্গে ফেল্ কর্ রে লোপাট রক্ত-জমাট
শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী!
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ! ধ্বংস-নিশান
উঠুক প্রাচী-র প্রাচীর ভেদি’॥
গাজনের বাজনা বাজা!
কে মালিক? কে সে রাজা? কে দেয় সাজা
মুক্ত-স্বাধীন সত্য কে রে?"
"নাচে ঐ কাল-বোশেখী, কাটাবি কাল ব’সে কি?
দে রে দেখি ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি’।
লাথি মার, ভাঙ্রে তালা! যত সব বন্দী-শালায় —
আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, ফেল্ উপাড়ি॥"
বিদ্রোহী কবিতার মতো তাঁর বিদ্রোহী গানগুলিও ছিল এক একটা জ্বলন্ত অগ্নিতীর । প্রথম জীবনে সৈনিক ছিলেন তিনি । প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অকুতোভয়ে যুদ্ধ করেছেন, তাই তাঁর হৃদয় ছিল সিংহ-হৃদয় । নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ভালোবেসেছিলেন দেশকে । ব্রিটিশদের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে নিজ মাতৃভূমি ভারত মাতৃকাকে মুক্ত করতে তাই তিনি অকুন্ঠ সমর্থন জুগিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের । তাঁর কবিতা, তাঁর গানে উজ্জীবিত হয়ে উঠতো লক্ষ লক্ষ তরুণ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হৃদয় । তাঁদের মধ্যে একজনের নাম আপনারা সবাই জানেন, যাঁর সিংহনাদে ব্রিটিশ শাসনের ভিত নড়ে গিয়েছিলো - "চলো দিল্লী, তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব ।" হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস । তিনি ছিলেন কবি নজরুলের গুণমুগ্ধ ।
কলকাতায় সর্বভারতীয় কংগ্রেসের একটি সভায় নেতাজি বক্তব্য রাখতে গিয়ে কাজী নজরুলের নাম উল্লেখ করে বলেন স্বাধীন ভারতে একমাত্র এই বাঙালি কবিই জাতীয় কবির মর্যাদা পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন । অথচ ভাগ্যের কী নিদারুন পরিহাস, জাতীয় কবির মর্যাদা তিনি ঠিকই পেলেন, কিন্তু, তাঁর মাতৃভূমি ভারতবর্ষে নয়, বিদেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে ।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে এমন একজন কবিকে আমরা নিজেদের দেশে ধরে রাখতে পারিনি । তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার (ইন্দিরা গান্ধীর সরকার) আর পশ্চিমবঙ্গের সরকার কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী সিদ্বার্থ শংকর বসু কবি নজরুলের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি একটুও । তাই এক কূট রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কবি হলেন দেশহারা । ১৯৫৩ সালের পর থেকেই কবি বাকরুদ্ধ ছিলেন, এর পরে যুক্ত হয় ওনার মানসিক ভারসাম্যহীনতা । কয়েক বছর রাঁচিতে চিকিৎসাও নিয়েছিলেন । কিন্তু, সুস্থ হতে পারেননি ।
বাকশক্তি রহিত, মানসিক ভারসাম্যহীন এক বৃদ্ধকে ১৯৭২ সালে ঢাকায় নিয়ে যায় তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর সম্মতিতে । ইন্দিরা গান্ধী সম্মতি দিলেও পশ্চিমবঙ্গের জনগণ সেদিন সম্মতি দেয়নি । কয়েক লক্ষ মানুষের ঢল নেমেছিল সেদিন রাজপথে । তাঁদের প্রিয় কবিকে ছিনিয়ে নেওয়ার দিনে বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছিল সেদিন কলকাতার রাজপথ ।
ইন্দিরা গান্ধীর সরকার সেদিন দেশবাসীকে বুঝিয়েছিল যে কবিকে অল্প কিছুদিনের জন্য মাত্র ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, চিরকালের জন্য নয় । শেখ মুজিবও নাকি সেই চুক্তি করেই কবিকে ঢাকায় আনেন । কিন্তু, মাত্র ৩ মাসের মাথায় শেখ মুজিবের কথা পুরো ১৮০ ডিগ্ৰী ঘুরে যায় । তিনি চেষ্টা চালাতে থাকেন কবিকে আজীবনের জন্য ঢাকায় রেখে দিতে । ইন্দিরার সাথে এক হীন চুক্তি হয় অবশেষে । আর তারই পরিণাম হলো বাংলাদেশে কবিকে চিরকাল রেখে দেওয়া ।
কবি নজরুলের শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে তাঁর গ্রাম চুরুলিয়ায় পত্নী প্রমীলা দেবীর কবরের পাশে শায়িত করা হোক । এই কথা কবির পুত্র কাজী সব্যসাচী নিজে বলে গিয়েছেন । অথচ, এখানেও মিথ্যা কথা বলে কবিকে ঢাকায় সমাধিস্থ করা হলো ।
অন্নদাশঙ্করের সেই লেখা -
"ভুল হয়ে গেছে বিলকুল,
আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নিকো নজরুল ।"
অথচ সেই নজরুলকেই ভাগ করা হলো অবশেষে। শেকড় ছিঁড়ে ভিনদেশে তাঁকে সমাহিত করা হলো । তখন অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে অন্নদাশঙ্কর লিখেছিলেন -
"কেউ জানল না ইতিহাসে ফের
ভুল হয়ে গেছে বিলকুল,
এতকাল পরে ধর্মের নামে
ভাগ হয়ে গেল নজরুল।"
তবে ব্যক্তি নজরুলকে হারালেও আমরা তাঁর লেখনীকে আজও হারাইনি । সেই হিসেবে বলাই যায় - "আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে, ভাগ হয়নিকো নজরুল ।"
------- ধন্যবাদ -------
পরিশিষ্ট
Account QR Code
VOTE @bangla.witness as witness
OR
আপনার পুরো পোষ্টটি পড়ে অনেকটাই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম দাদা। এত চমৎকার ভাবে ইতিহাসটি বর্ণনা করেছেন যা সত্যি আগে আমি জানতাম না। তবে আমাদের কাজী নজরুল ইসলামকে সেখানেই তার মাতৃভূমিতেই দাফন করা উচিত ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর কারণে সেটা আর হয়ে উঠে নি। আমাদের জাতীয় কবিকে অনেক ভালোবাসি। দুই বাংলার সম্মতিতে যদি সব কাজগুলো হতো তাহলে অনেকটাই ভালো। শ্রদ্ধেয় কাজী নজরুল ইসলামের রনসংগীত এবং বিভিন্ন ধরনের বিদ্রোহী কবিতা মনে হয় যেন এক জ্বালাময়ী ভাষণ, কবিতা গুলো পড়লেই মনে হয় রক্ত টগবগ করে উঠে। অনেক জ্ঞানী গুণী একজন ব্যক্তি ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা, ইতিহাসের বিষয়গুলো এত চমৎকার ভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য।
কাজী নজরুল ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে আপনার ব্লগটি কি পড়ে অনেকটা ধারণা পেলাম। আপনি আজকে বিদ্রোহী কবির অনেকগুলো বিদ্রোহী কবিতা শেয়ার করেছেন। যে কবিতা গুলো আমি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে পড়েছিলাম। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা গুলি পড়লে মনে হয় যেনো নিজের মধ্যে একটি বিদ্রোহী ভাব সৃষ্টি হয়। আমাদের জাতীয় কবির শুনলে চোখ দিয়ে পানি চলে আসে। তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নিজের লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছিলেন। চেনার প্রত্যেকটা কবিতা পড়লে মনের মধ্যে সাহস ও বল জন্মায়। আমরা আসলেই অনেক গর্বিত এমন একটি কবি আমাদের বঙ্গ দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নজরুল জয়ন্তীর এই সুন্দর ব্লগটি আমাদের মাঝে শেয়ার করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা।
Congratulations, your post has been upvoted by @nixiee with a 100 % upvote Vote may not be displayed on Steemit due to the current Steemit API issue, but there is a normal upvote record in the blockchain data, so don't worry.
Congratulations, your post has been upvoted by @upex with a 41.06% upvote. We invite you to continue producing quality content and join our Discord community here. Keep up the good work! #upex
This post has been upvoted by @italygame witness curation trail
If you like our work and want to support us, please consider to approve our witness
Come and visit Italy Community
Hi @rme,
my name is @ilnegro and I voted your post using steem-fanbase.com.
Come and visit Italy Community
Thank you, friend!
I'm @steem.history, who is steem witness.
Thank you for witnessvoting for me.
please click it!
(Go to https://steemit.com/~witnesses and type fbslo at the bottom of the page)
The weight is reduced because of the lack of Voting Power. If you vote for me as a witness, you can get my little vote.
You must really like Nazuru Jayanti, for you have given a well detailed information on him.
Indeed he was a great poet as I have learnt so much about him from your blog.
Thank you for sharing this with us Dada ☺️❤️❤️❤️
নজরুল জয়ন্তীতে সবাইকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন। আজকের এই দিনে পৃথিবীতে শ্রদ্ধেয় প্রিয় কবি শুভ আগমন করেন। প্রিয় কবি নজরুল সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় বিচরণ করেন সমানভাবে। তার কাব্য, গদ্য, প্রবন্ধ, বিদ্রোহী কবিতা সমূহ, সঙ্গীত, এবং ইসলামী সংগীত হৃদয়ের মাঝে অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি করে। বিশেষ করে তার বিদ্রোহী কবিতা এবং ইসলামিক সংগীত হৃদয়ের মাঝে কাঁপন সৃষ্টি করে। আসলে প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী । আজকের এই দিনে তার প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। তিনি বাংলা সাহিত্যকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। নজরুল জয়ন্তী পোস্টটি আমাদের মাঝে শেয়ার করার জন্য শ্রদ্ধেয় দাদা আপনাকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
শেষের কাহিনী গুলো জানা ছিলোনা।ইতিহাস কতো বদলে যায় দেশ থেকে দেশে ভাবাই যায়না!কারণ আমাদের এদিকে এসব কখনো শোনাই হয়নি বা তেমন কোথাও উল্লেখ ও করা হয়নি।উনার লেখনী ভালোবাসি সেই ছোটবেলা থেকে। বিদ্রোহী কবিতাগুলো পড়েই তো বড় হওয়া।