ছোটবেলার ফল-পাকুড় চুরির কিছু মজার ঘটনা - "ডাব ও নারিকেল চুরি করে খাওয়া"
আমার ছোটবেলায় গ্রামে একটা অদ্ভুত মজার উৎসব ছিলো । বিশেষ করে ছোটদের কাছে এই উৎসবটি ছিলো খুবই মজার । জানি না এখন আর গ্রাম বাংলার কোনো স্থানে এই রেওয়াজ চালু আছে কি না । এই উৎসবটির নাম ছিল "নষ্টচন্দ্র", অবশ্য গ্রাম্য মানুষের মুখের ভাষায় "নষ্ট চন্দর" । এই নষ্টচন্দ্র পালিত হতো বর্ষার শেষে । যতদূর মনে পড়ে ভাদ্র মাসে হতো উৎসবটি । চাঁদ যখন ক্ষয়াটে হয়ে উঠতো সেই সময় আমরা নষ্টচন্দ্র উদযাপন করতাম ।
নষ্টচন্দ্রের রাতে অন্যের গাছের ফল-পাকুড় চুরি করে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল । এবং এই চুরি করে অন্যের গাছের ফল খাওয়া যেহেতু একটি ধর্মীয় উৎসবের অঙ্গ ছিল তাই এই দিন কোনো নিষেধ তো ছিলই না বরং উৎসাহ উদ্দীপনার ভীষণই মজার একটি উৎসব ছিল ।
আমাদের কাছে অবশ্য বছরের সবক'টি দিনই নষ্টচন্দ্র ছিল । বারোমাস-ই কারো না কারো গাছের ফল চুরি করে খেতাম আমরা ।
চৈত্র মাস থেকে শুরু আর জৈষ্ঠ্য মাস অব্দি চলতো আমাদের গ্রীষ্মকালীন "ফল চুরি উৎসব" । এসময়টায় কাঁচা আম, পাকা আম, পেয়ারা, ডাব, নারিকেল, জাম, জামরুল, তরমুজ এসব চুরি করে খেতাম দেদার পরিমাণে । কাঁঠাল আমরা ছুঁতাম না । আঠার একটা প্রব্লেম ছিলো তো , তাই ।
গ্রীষ্মকালীন এই সময়টায় আমরা সব চাইতে বেশি চুরি করে খেতাম আম আর ডাব । সেদিন তো কাঁচা আম চুরির গল্পটা বললাম, আজকে বলি ডাব চুরি করে খাওয়ার গল্প ।
শীতকালে আমাদের যে ক্রিকেটের টুর্নামেন্ট শুরু হতো তা কিন্তু পুরো ফাল্গুন, চৈত্র আর বৈশাখ মাসেও চালু থাকতো । গরমের দিন । সারাক্ষন পিপাসায় কাতর আমরা ক'জন হতভাগার দল । এ পিপাসা জলে নিবারণ হবার নয় । এ পিপাসা ডাবের জল, তরমুজ, আইসক্রিম অথবা মেলার মাঠের বরফ দেওয়া শরবৎ বা কোল্ড ড্রিঙ্কসেই একমাত্র নিবারণ করা সম্ভব । চৈত্র মাসে আমাদের গ্রামে দুটো বড় বড় উৎসব হতো - বাসন্তী পুজো আর চড়ক পুজো (নীল পুজো) । ছোটবেলা থেকেই পুজো টুজো আমায় টানে না । তাই আমাদের টার্গেট থাকতো এই দুই পুজো উপলক্ষে আয়োজিত বিশাল বিশাল মেলা । বাসন্তী পুজোয় চলতো ৪ দিন ব্যাপী মেলা আর চড়ক পুজোয় ৩ দিন । আর ছিল পয়লা বৈশাখে । এক মাসের মধ্যে তিন তিনটি বিশাল মেলা । মেলায় খেতাম এন্তার আইসক্রিম, ছোলা মাখা, পাঁপড়, বরফ দেওয়া শরবত আর কোল্ড ড্রিঙ্কস । মেলার গল্প আরেকদিন করবো ।
গরমে আমরা স্নান করতে যেতাম দলবেঁধে । আমার বন্ধুরা সবাই জলে ঝাঁপাঝাঁপি করতো, শুধু আমাদের বাড়ির ছেলেদের মানা ছিল পুকুরে স্নান করায় । আমরা তাই টিউবওয়েলের জলেই স্নান সমাপন করে বাড়ি ফিরতাম, লক্ষ্মী ছেলে হয়ে । হায় রে ! আমাদের বাড়ির লোকেরা এটাই বিশ্বাস করতো । কিন্তু, কেস ছিলো পুরো উল্টো । আমরা আসলে কি করতাম সেই গল্পই আজ করতে বসেছি ।
স্নানের সময় পেতলের বালতি, ঘটি, গামছা, সাবান আর তেল এ সব কিছু নিয়েই লক্ষ্মী ছেলের দল আমরা যেতাম পুকুর পাড়ে । বিশাল শান বাঁধানো পুকুর ঘাট ছিল আমাদের । ঘাটের ঠিক বাম পাশেই বেশ কিছুটা জায়গা প্লাস্টার করে একটি চাতাল বানানো । চাতালের চারিপাশে বুনো লতা-ঝোপঝাড়ের বেড়া দেওয়া । আর ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটি ডিপ টিউবওয়েল । ওটাই আমাদের স্নান করার স্থল ।
বাড়ি থেকে আমরা ছেলের দল যখন বেরোতাম তখন বাড়ির চাকরবাকর বাদে আর সবার স্নান সমাপন সারা । বাবা, জেঠু, কাকারা তখন সবাই যাঁর যাঁর কর্মস্থলে । তো ফাঁকা মাঠে গোল দিতে বাধা কোথায় ? বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় তাই কৌশলে একটি ধারালো দা (কাটারি) সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম ।
বাড়ি থেকে বেরিয়েই পুকুর পাড়ে এসে সবাই মিলিত হতাম । এরপরে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতাম কার বাগানে যাবো আজ । পুকুরের কাছাকাছিই যেতে হবে । দূরে হলে হবে না । দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পরে দলবেঁধে নিঃশব্দে আমরা সবাই বাগানে হাজির হয়ে যেতাম । চারদিকে নিঃঝুম দুপুর বেলা । জনমানব শূন্য চারিধার । ভালো ডাবওয়ালা গাছ দেখে দ্রুত দলের মধ্যে থেকে গাছ বাইতে এক্সপার্ট দু'তিন জন ডাবগাছে উঠে পড়তো । আমরা নিরাপদ দূরত্বে সরে দাঁড়াতাম । আর উপর থেকে ডাবের বোঁটা কেটে ছুঁড়ে ছুঁড়ে জলের মধ্যে ফেলে দিত বন্ধুরা । মাটিতে ফেলতো না ফেটে যাওয়ার ভয়ে । তাও দু'চারটে মাটিতে পড়তো , তবে নরম মাটিতে পড়লে ফাটতো না ।
বৈশাখ মাস , ডোবায় তেমন জল থাকতো না, ডাবগুলি কাদার মধ্যে ঢুকে যেত । হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে খুঁজে সেগুলো বের করে ধুয়ে পরিষ্কার করে আনা হতো । এরপরে, একটি ছায়াময় নিরিবিলি শান্ত নির্জন ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে ডাব গুলো দ্রুত কেটে ফুটো করে জল খাওয়া চলতো । যে যত পারে ডাবের জল খেত । কারণ প্রায় গোটা তিরিশের নিচে ডাব নামানো হতো না । জল খাওয়ার পরে ডাব গুলি এক এক করে মাঝখান থেকে কেটে দুই ভাগ করে তার মধ্যে থেকে নরম শাঁস খাওয়া হতো ।
খাওয়া দাওয়া শেষে ভাইদের মধ্যে কেউ কেউ মাটিতেই শুয়ে পড়তো । নড়তে চড়তে না পেরে । তাদের একটু সুস্থ হওয়ার টাইম দিতাম আমরা নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা করতে করতে । এরপরে, সোজা পুকুরের জলে । জোঁকের কোনো ভয় ছিল না আমাদের । বরং, কারো পায়ে জোঁক লাগলে অন্যজন টেনে তুলে ফেলতো ।
পুকুরের জলে বিস্তর আমোদ আল্লাদ করে, জল ঘোলা করে সবাই উঠে কলতলায় গিয়ে আরেক প্রস্থ স্নান সমাপন করে লক্ষ্মী ছেলের দল বাড়ি ফিরত । সপ্তাহে অন্তত এক-দুই দিন দুপুরবেলায় ডাব চুরি করে খেতাম আমরা এই ভাবেই ।
আমি এই উৎসবের নাম নতুন শুনছি।তবে এটি জানি লক্ষ্মী পূজার রাতে চুরি করে খাওয়া যায় সারারাত জেগে।
বাহ,বেশ মজার ঘটনা ছিল তো।খুবই ভালো লাগছে আপনার ছোটবেলার গল্প পড়ে।তবে আপনি যে ছোটবেলায় এত দুস্টু ছিলেন দাদা আপনাকে দেখলে বোঝাই যায় না।পুরো উল্টো হয়ে গেছেন দাদা!😊😊আপনার গল্প পড়তে পড়তে ছোটবেলার অনেক ঘটে যাওয়া ঘটনা দুস্টুমির কথা আমার ও মনে পড়ে যাচ্ছে।ধন্যবাদ দাদা।
@tipu curate 10
Upvoted 👌 (Mana: 0/10) Get profit votes with @tipU :)
দাদা আপনার ছেলে বেলা কেটেছে দারুন মজায়। জানতে ইচ্ছে হয় গ্রামের বাড়ী টি এখন কেমন আছে। ডাব তেমন একটা খাওয়া হয় নাই আমাদের কারন কেউ নারকেল গাছ বাইতে জানতে না। তবে গ্রামের বাড়ীতে গেলে কুটু নামের ছেলেটি আসতো আমাদের বাড়ীতে। ও নারকেল গাছে উঠে ডাব গুলোকে জমানো গাছের পাতার মধ্যে ফেলে দিত তাতে ডাব আর ফাটতো না। আপনার জীবনের গল্পটি পড়ে ছেলে বেলার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। নষ্টচন্দ্র এমন ধরনের উৎসব শুনিনি তবে নীল পূজো বাড়ীতে হতো । এখনও হয়। ধন্যবাদ দাদা ছেলে বেলায় চলে গিয়েছিলাম আপনার গল্প পড়তে পড়তে। ভাল থাকবেন । ধন্যবাদ।
দাদা এই জিনিসটা শুনেই তো আমার ভয় লাগতেছে ।কারন আমি সাপ ভয় পাইনা কিন্তু জোক দেখলেই ভয় পাই। যাইহোক আপনার ডাব চুরির ঘটনা টা পড়ে খুবই ভালো লাগলো। সপ্তাহে যদি ১/২ দিনই যদি ডাব চুরি করে খেতেন তাহলে সারা গ্রামের ডাব আর থাকতো কিনা তাই চিন্তা করতেছি ।খুব মজা ছিল ছোটবেলার মুহূর্তগুলো ।তবে যদিও আমরা আপনাদের মত ডাব চুরি করে খেতে পারতাম না।আম চুরি করে তো খাওয়াই যেতো। মজাই লাগলো আপনার গল্পটি পড়ে। ছোটবেলার সেই ফল চুরির ঘটনা গুলো মনে পড়ে গেল।
নষ্টচন্দ্র নামে এই উৎসবের কথা জীবনে এই প্রথম শুনলাম। আমার মনে হয় আমাদের এদিকে এ ধরনের কোনো উৎসব কখনো হয়নি। হলে কি মজাটাই না হতো। আসলে শৈশবের এই দস্যিপনা আর নির্ভেজাল আনন্দের সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা হয়না। কোটি কোটি টাকার বিনিময়েও ফিরে পাওয়া যাবে না এই সময়। ডাব চুরীতে আপনাদের হাত একেবারে পেকে গিয়েছিল মনে হচ্ছে
অভিনব সব কৌশল আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। প্রতিদিন আপনার দারুন দারুন সব অভিজ্ঞতা গুলো জানতে পেরে ভালই লাগছে। আমার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে অনেকটাই।
কি অবস্থা ছিলো তখন, খেয়ে পুরাই কাত হা হা হা হা। ডাবগুলোর জন্য বেশ আফসুস হচ্ছে আমার আর গাছের মালিকের কথা নাইবা বল্লাম হা হা হা। সত্যি এই রকম দুরন্তপনা আর মজার করার সুযোগ এখন আর নেই। বেশ মজার সময় কাটিয়েছেন আপনি।
এতোগুলো ডাব একবারে সাবাড়!
বাপরে বাপ!
নষ্ট চন্দ্র উৎসব আপনার জন্যেই সার্থক।
বিশ্বাস ই তো হচ্ছেনা আমার।
আপনি দাদা কি যে ছিলেন তাই তো ভেবে কুল পাচ্ছিনা আমি,হাসতে হাসতে শেষ আমি।
দাদা আপনার পোষ্টটি পড়তে পড়তে শৈশবকালের পুনরায়বৃওি করছিলাম।কত যে আম ছুরি করে এনেছি আচার দেয়ার জন্য আর ডাব খাওয়া টা তো ছিলো রীতিমতো একট। রেওয়াজ।
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার শৈশবকালে ফিরে নেওয়ার জন্য।
কি দুরন্ত কেটেছে আপনার ছোটবেলা! আর কি ভাগ্য আপনার দাদা সমবয়সী বা এরকম দুরন্তপনার জন্য ঠিক ঠাক মানুষ জনও পেয়েছিলেন। আর মাঝে মাঝেই ত্রিশাটার মত ডাব ছিনতাই করা! ইস, যদি সেই দলে থাকতাম তাহলে এডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে পারতাম। আপনাদের কথা ভেবে ভাল লাগছে কিন্তু অন্য পক্ষ যখন দেখত তাদের গাছ থেকে হঠাত করে এই পরিমাণ ডাব উধাও খোদাই জানে তাদের কি হাল হত! 😁
Beautiful Lines loved it so much!!!