ভৌতিক গল্প : "মৃত্যুর কাছাকাছি" - পর্ব ০৫ [শেষ পর্ব]

in আমার বাংলা ব্লগ3 years ago


copyright free image source pixabay

চতুর্থ পর্বের পর


পাঁচ (শেষ পর্ব)

লণ্ঠনের শিখা মাঝে মাঝে দপদপিয়ে উঠছে আবার স্তিমিত হয়ে পড়ছে । বড়জোর আর মিনিট দশেকের মতো তেল আছে । আজ বেরোনোর সময় লণ্ঠনে তেল ভরতে ভুলে গেছে সে । আসলে শেষ রাতের দিকে মোটামুটি ধূসর আলো থাকে চারিদিকে; তাতে আর যাই হোক না কেন মাছ ধরতে কোনো সমস্যা কোনো কালেই হয় না । তাই সে আর গা করে না, কোনো কোনোদিন কম তেলেই লণ্ঠন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে । আজকেও তাই হয়েছিল । এক ছোট্ট ভুলের এত বড় মাশুল দেওয়া লাগবে শেষটায় ?

যেই মুহূর্তে লণ্ঠনের শিখা নিভে যাবে সেই মুহূর্তে দুলালের জীবনদীপও নিভে যাবে । সব কিছু এখন নির্ভর করছে একটি মাত্র অগ্নিশিখার উপর । দুলাল চোখ বুজে একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগলো পরিত্রানের উপায় । সে স্কুল কলেজে পড়েনি ঠিকই কিন্তু উপস্থিত বুদ্ধি তার মোটেও কম নেই । সে জানে বিপদের সময় মাথা গরম করলে বা খুব ঘাবড়ে গেলে বিপদ তো কমেই না বরং উল্টে বেড়ে যায় । বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রাখাটাই একমাত্র বুদ্ধিমানের কাজ । মাথা ঠান্ডা রেখে পরিত্রানের পথ খুঁজলে পাওয়া যাবেই যাবে। বিপদে ভয় করলে তো তুমি গেলে । নিজের বুদ্ধি, সাহস আর সামর্থ্যের উপর পূর্ণ আস্থা রেখে শক্ত ভয়শূন্য হৃদয়ে বিপদের মোকাবেলা করলে বিপদ থেকে পরিত্রানের পথ মিলবেই মিলবে; তা সে যত বড় বিপদই হোক না কেন ।

আকাশ পাতাল ভেবেই চলেছে দুলাল । এদিকে লণ্ঠনটার শিখা ভয়ানক দপদপ করছে । এখন যদি একটু জোরে হাওয়া দেয় তো মুহূর্তের মধ্যে নিভে যেতে পারে । পিশাচটা এখনও গোল হয়ে ঘুরছে দুলালের চারিদিকে । ঘোরার গতি আর গর্জনের বেগ বেড়ে গেছে তার । খুশি এখন সে, কারণ সেও বুঝতে পেরেছে আর মাত্র কিছুক্ষন; তারপরেই লণ্ঠন নিভে যাবে আর শিকার তার হাতে এসে যাবে । খিদে পেয়েছে তার ভীষণ । ঘন ঘন ঠোঁট চাটছে ।

দীপ নিভে যাওয়ার আগে শিখার ঔজ্বল্য বৃদ্ধি পায়; দুলালের লণ্ঠনের শিখার আলোও হঠাৎ বেড়ে গেলো । দুলাল বুঝলো শেষ সময় আগত । ইষ্ট নাম জপার সময় এসে গেছে । হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো একটা কথা মনে পড়ে গেলো তার । হাটখোলায় সে তো লণ্ঠনটা হাত থেকে নামিয়ে পাশে রেখে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো তবুও পিশাচ তার কাছে ঘেঁষেনি কেনো ?

তার একটাই কারণ সে বিড়ি টানছিলো । বিড়ির আগুন যতই ছোট্ট একটা স্ফুলিঙ্গ হোক না কেন তা পিশাচকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে । এটাই দুলালের একমাত্র শেষ সুযোগ পরিত্রাণ পাওয়ার ।লণ্ঠনের আগুন নিভে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে দুলাল বাঘের মতো বীরবিক্রমে পূর্ণ শক্তিতে প্রবলভাবে হামা দিয়ে যেখানে সে তার ধুতি-গেঞ্জি খুলে রেখে জলে নেমেছিল সেখানে হাজির হলো । একহাতের মুঠিতে শক্ত করে লণ্ঠনটা ধরে রেখে দ্রুত বিড়ির বান্ডিলটা খুঁজতে লাগলো । লহমায় পেয়ে গেলো সেটি, প্রায় পুরো বান্ডিলটাই ভরা আছে বিড়িতে ।

মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদ্যুৎবেগে একটা বিড়ি ধরালো দুলাল । প্রায় সঙ্গে সঙ্গে লণ্ঠনের শিখাটা একবার ভীষণভাবে দপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেলো ।

কানফাটা একটা গর্জন করে উঠলো পিশাচটা । তার তখন ভয়ঙ্কর রূপ । শিকার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে । অথচ কোনোক্রমেই দুলালকে ছুঁতে পারছে না সে । কারণ ওই আগুন । দুলালের মতলব তখন পিশাচের কাছেও পরিষ্কার । বিড়ির বান্ডিলটাতে কম করে হলেও প্রায় কুড়িটা বিড়ি আছে । একটা বিড়ি পুরো পুড়ে নিঃশ্বেষ হতে ৫-৬ মিনিট লাগে; তার মানে দুলাল এখনো ঘন্টা দুই আগুন ছুঁয়ে থাকবে । অথচ ভোর হওয়ার আর খুব বেশি দেরি নেই । দিনের আলোয় পিশাচের শরীর শুধুই একটা ধোঁয়ার কুন্ডুলিতে পরিণত হবে, দুলালের কোনো ক্ষতি করার সাধ্য থাকবে না তার ।

তবুও পিশাচটা দুলালের আশা ছাড়তে পারছে না । কিছুটা তফাতে ঝোপের ধারে বসে দুলালের দিকে অগ্নিময় দৃষ্টিতে একপলকে তাকিয়ে রইলো সেটি । তার আশা, শ্রাবণ মাস, যে কোনো সময়ে বৃষ্টি নামলে বিড়ির আগুন আর কতক্ষণ! নিমেষে নিভে যাবে । তখন এক লহমায় দুলালের ঘাড়ে কামড় বসাতে পারবে সে ।

দুলাল বোকা নয় মোটেও । বিপদের প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে সেও একই চিন্তা করতে লাগলো, যদি বৃষ্টি নাম তাহলে আর রক্ষে থাকবে না । দ্রুত ধুতিটা একটা পাগড়ির মতো করে মাথায় পরে নিলো সে তার পরে চাপালো টোকাটা, আর তার তলে বিড়ির বান্ডিলটা সুরক্ষিত রইলো । যদি সহসা বৃষ্টি নামে তো তার মুখের বিড়ি আর বান্ডিলের বিড়ি কোনোটাই আর ভিজবে না সহজে ।

এরপর দ্রুত হাটখোলার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো । যদি হাটখোলার কোনো একটা চালার নিচে পৌঁছাতে পারে তো নিশ্চিন্ত হতে পারে বৃষ্টির ব্যাপারটায়; হাটখোলা কাছেই, খুব একটা দূরে নয় ।

পিশাচটা এইবার হাল ছেড়ে দেয়ার মতো তর্জন গর্জন লাফালাফি শুরু করলো । দুলাল মোটেও ভ্রুক্ষেপ না করে সটান হাঁটা দিলো । বুকে তার সাহস ফিরে এসেছে পুরোটাই । পিশাচ তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, সে নিশ্চিত ।

পিছন পিছন ধুপ ধাপ করে ভারী ভারী পা ফেলে পিশাচটা পিছু নিলো । দুলাল খুবই দ্রুত পায়ে হেঁটে মিনিট পনেরোর মধ্যে হাটখোলার চালাঘরে এসে পৌছালো । এ পর্যন্ত তার মাত্র ৪টে বিড়ি খরচ হয়েছে । যখনই একটা বিড়ি শেষ হয়ে আসছিলো তখনি তার আগুনে সে আরেকটা বিড়ি ধরিয়ে নিচ্ছিলো ।

পিশাচটা উবু হয়ে শিমুলগাছটার তলে বসে রইলো । এখনো সে আশা ছাড়তে পারেনি ।

ধীরে ধীরে সময় বয়ে চললো । অবশেষে পুব দিগন্তে দেখা দিলো চিরদিনের চেনা লাল সূর্য । জীবনে কোনো সূর্যোদয় দেখে এতটা আনন্দ দুলাল আর পায়নি । নব প্রভাতের সূর্য কিরণের প্রথম ছটায় গতরাতের বিভীষিকা সম্পূর্ন মুছে দিলো । শিমুলতলে তাকালো দুলাল । শূন্য । কেউ নেই ।

বাড়ির পথ ধরলো দুলাল । গতরাতের কথা সে কোনোদিনও ভুলবে না । মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলো সে । তার জীবন-সুতা নির্ভর করেছিল একটা তুচ্ছ বিড়ির ছোট্ট একটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের উপর, যে কোনমুহূর্তে সেই সুতাটা ছিঁড়ে যেতে পারতো । শুধু তার উপস্থিত বুদ্ধিই তাকে এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিলো ।


[শেষ]

Sort:  
 3 years ago 

চেষ্টা কখনো বিফলে যায় না। দুলাল তার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে গেছে বাঁচার জন্য অবশেষে বেচারা রক্ষা পেল।আমিও চেয়ে ছিলাম বেচারা যেন রক্ষা পায়।যদিও এটা গল্প তবুও গল্প পড়তে পড়তে বাস্তবতায় স্থান দিয়ে ছিলাম। সব মিলিয়ে অসাধারণ একটি গল্প উপহার দিয়েছেন দাদা আমাদের মাঝে। দাদা দুলালকে শেষমেষ উদ্ধার করেই ছাড়লো।এতো সুন্দর গল্প উপহার দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।আশাকরি আরো সুন্দর সুন্দর গল্প উপহার পাবো আপনার কাছ থেকে।

 3 years ago 

দারুন একটি উত্তেজনা, টান টান উত্তেজনা, কি যে হয় দুলালের, এটা ভাবতে ভাবতে আমার মতো পাঠকরা হৃদ স্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল।
শেষে বেলা উঠার সাথে সাথেই আমরাও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
সবমিলে অনেক সুন্দর একটা কেচ্ছা আমাদের নিকট শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
আপনি ও আপনার পরিবারের জন্য শুভ কামণা রইল। ভালো থাকবেন।

 3 years ago 

উপস্থিত বুদ্ধি এবং প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে অবশ্যই জীবনে বড় বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। দাদা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে গেল জীবন দুলাল তার জীবনকে বাঁচাতে পারল।

 3 years ago 

জয় বিড়ির জয়। যে বিড়ি মানুষের ক্যান্সারের কারণ সেই বিড়ি আবার মাঝে মাঝে জীবনো বাঁচিয়ে দেয়৷ আসলে কোন জিনিসকেই তুচ্ছ করা ঠিক নাহ্। কখন কোনটা কাজে লাগে, বলা খুব মুশকিল । জাস্ট অসাম ফিনিশিং দাদা।

 3 years ago (edited)

খুবই সুন্দর হয়েছে দাদা, পুরো গল্পটাই।তবে শেষ টা হয়েছে দুর্দান্ত এবং টান টান উত্তেজনাপূর্ণ।দুলাল বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রেখে তার উপস্থিত বুদ্ধি কে কাজে লাগিয়েছে এবং ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাই সে বাঁচতে পেরেছে।এই গল্প থেকে বোঝা গেল যে বিপদের সময় ভয় না পেয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দাদা এত সুন্দর একটি গল্প আমাদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য।

 3 years ago 

উপস্থিত বুদ্ধি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যা সবার থাকে না। দুলাল এইরকম একটি বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার পেছনে তার উপস্থিত বুদ্ধি এবং ধৈর্য্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। পিশাচ দেখে সে দৌড় দিতে পারত কিন্তু সে দেয়নি কারণ সে বুঝে গিয়েছিল এতে কোন লাভ হবে না, এখানেও দুলাল তার চতুর বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। এই গল্পের শিক্ষা হলো বিপদে আমাদের মাথা ঠান্ডা রেখে চিন্তা করতে হবে। অতি ব‍্যস্ত হয়ে নতুন কোনো বিপদ সৃষ্টি করা যাবে না।

Thank You for sharing Your insights...

and Your art.

 3 years ago 

সত্যিই দুলালের উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা না করলেই নয়।আগের অংশ পর্যন্ত পড়ে মনে হয়েছিল দুলালের বুঝি এ জাত্রায় রক্ষা হবে না।গল্পের শেষটা সুন্দর হয়েছে। ধন্যবাদ দাদা এত সুন্দর একটি গল্প আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।

 3 years ago 

গল্প টা থেকে এটাই শিক্ষা নিলাম,কখনো হাল ছেড়ে দিতে হয় না,চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে সফলতা একদিন আসবেই। যেমন টা,দুলাল তার শেস নিশ্বাস পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছে এবং সাফল্যের দেখা পেয়েছে।
ধন্যবাদ দাদাকে,এতো সুন্দর একটি অনুপ্রেরণা মূলক গল্প উপহার দেওয়ার জন্যে

 3 years ago 

যাহোক অবশেষে দুলাল প্রণে বেঁচে ফিরল, গল্পের একটি সুন্দর সমাপ্তি হলো।

 3 years ago 

হা, হা, হা, হা, হা
এটা একটা প্রশান্তির হাসি, শেষ দৃশ্যটার জন্য।
আমি আগেই বলেছিলুম, লেখকের মতি গতি ঠিক নেই, ঘুরে যেতে পারে সব কিছু। তবে খুব সুন্দর সমাধান দিয়েছেন, এটা কাংখিত ছিলো সকলের জন্য।

তবে হ্যা, একটা কথা বলতেই হবে, বিপদের সময় যতটা বেশী চিন্তিত হয়ে পড়বেন এবং ঘাবড়ে যাবেন, বিপদ কিংবা সমস্যা ততোবেশী বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং আমরা যদি ঠান্ডা মাথায় সব কিছু চিন্তা করি, তাহলে সহজেই সকল কিছুর সমাধান সম্ভব। অনেক ভালো লেগেছে গল্পটি ভৌতিক হলেও শিক্ষনীয় অনেক কিছু ছিলো তার মাঝে।

ভিন্ন কোন বিষয় নিয়ে, পরের নতুন কোন গল্পের অপেক্ষায় রইলাম আমরা।

Coin Marketplace

STEEM 0.18
TRX 0.13
JST 0.028
BTC 57605.40
ETH 3085.50
USDT 1.00
SBD 2.31