ঐতিহাসিক লালবাগ ভ্রমণ : দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব (১০% বেনিফিসিয়ারি @shy-fox এবং ৫% @abb-school কে)
নমস্কার, আমি দেবাদিত্য (@pap3)। সকলে আশা করি ভালোই আছেন। ঐতিহাসিক লালবাগ ভ্রমণের আজ দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যতম মহকুমা শহর লালবাগ। এই মুর্শিদাবাদ জেলা অবিভক্ত বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী ছিল তা আপনারা অনেকেই জানেন। প্রথম পোস্টে আমি লালবাগ শহরের এক ঐতিহাসিক স্থান কাঠগোলার বাগান ভ্রমণের কথা তুলে ধরেছিলাম। আজ আমি লালবাগের সবচেয়ে বিখ্যাত নিদর্শন হাজারদুয়ারি প্যালেস ভ্রমণের কাহিনী তুলে ধরব।
বাম হাতে দেখা যাচ্ছে হাজারদুয়ারি প্যালেস।
লোকেশন
কাঠগোলার বাগান থেকে বেরিয়ে একটি টোটো ধরে আমরা চলে আসি হাজারদুয়ারি প্যালেসের সামনে। তারপর ঢুকেই বাঁহাতে দেখতে পেলাম টিকিট কাউন্টার। সেখান থেকে দুটো টিকিট কাটলাম, টিকিট মূল্য জন প্রতি মাত্র ২০ টাকা। সঙ্গে নিলাম একজন গাইডকে। তারপর এগিয়ে চললাম হাজারদুয়ারী প্যালেসের সামনে। তবে এই প্রথমবার নয়, বহুবার হাজারদুয়ারি দেখতে গেছি। নিজের জেলাতেই অবস্থিত হওয়ায় বারবার দেখার সুযোগ ঘটেছে। এই প্যালেসের একদম গা দিয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথী নদী।
হাজারদুয়ারি প্যালেসের বর্তমান নাম হাজারদুয়ারি প্যালেস মিউজিয়াম এই হাজারদুয়ারি প্যালেস মিউজিয়াম দেখতে প্রতিবছর লক্ষাদিক মানুষের আগমন ঘটে। সারা বছর ধরেই টুরিস্টদের আনাগোনা চলতেই থাকে। সামান্য কিছু টাকার বিনিময় এখানে গাইড পাওয়া যায়। যারা এ প্রাসাদ সম্পর্কে বহু মূল্যবান তথ্য টুরিস্টদের সামনে তুলে ধরে। তাদের কাছ থেকেই অনেক কিছু জেনেছি হাজারদুয়ারি সম্পর্কে।
মূলত ইতালীয় স্থাপত্য রীতিতে এই প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছে। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে নবাব নাজিম হুমায়ুন জা এর আমলে এই প্রাসাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়। এর নির্মাণকার্যে খরচ হয়েছিল তৎকালীন ১৮ লক্ষ টাকা। জানা যায়, আসল ও নকল মিলে প্রায় ১০০০ টি দরজা রয়েছে এই প্রাসাদে। যে কারণে এই প্রাসাদের নাম হয়েছে হাজারদুয়ারি প্যালেস।
এই সেই প্রকান্ড সিঁড়ি।
এই প্রাসাদটি তিন তলা। একতলায় রয়েছে অস্ত্রাগার, অফিস। অস্ত্রাগারে বহু অস্ত্র রয়েছে, এর মধ্যে কিছু অস্ত্র রয়েছে যেগুলি পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। দোতলায় রয়েছে আর্ট গ্যালারি, লাইব্রেরী ও দরবার কক্ষ। এই দরবার কক্ষে দেখা যায় একটি সুবিশাল ঝাড়বাতি যেটি কি আলোকিত করে ৯৬ টি বৈদ্যুতিক বাল্ব দরবার কক্ষটি এই প্রাসাদের সর্ববৃহৎ কক্ষ ও অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এই প্যালেসে একটি আয়না রয়েছে যেটিতে নিজের মুখ কখনো দেখা যায় না, অথচ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির মুখ দেখা যায়। এই আয়নার পাশেই রয়েছে বহু বছরের পুরনো একটি কুমিরের মমি, যেটিকে পার্শ্ববর্তী ভাগীরথী বা গঙ্গা নদী থেকে ধরা হয়েছিল। মিউজিয়ামে দেখতে পাবেন ইংরেজদের ব্যবহৃত বহু জিনিসপত্র, যেমন পিয়ানো, বিলিয়ার্ড বোর্ড, টমটম গাড়ি আরো অনেক কিছু। আর্ট গ্যালারিতে রয়েছে বেশ কিছু মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য চিত্র। এছাড়াও এই মিউজিয়ামে রয়েছে হাতীর দাঁতের ও ব্রোঞ্জের তৈরি হাওদা, পালকি, অসংখ্য নবাবী আমলের দামী বাসনপত্র। লাইব্রেরীতে রয়েছে অসংখ্য পুরাতন ও মূল্যবান বই। সকল নবাব নাজিমদের বহু চিত্র এখানে দেখতে পাওয়া যায়।
সব ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে সবশেষে দরবার কক্ষ থেকে যখন বেরিয়ে আসছি তখন দেখতে পেলাম হাতির দাঁতের তৈরি হাজারদুয়ারির একটি রেপ্লিকা এবং ওর সাথেই রয়েছে হাজারদুয়ারির প্ল্যানটি। ওখানেই রাখা আছে রুপোর তৈরি একটি কুর্নি। গাইডদের কাছ থেকে জানতে পারি, হাজারদুয়ারী প্যালেসটি ইট ও চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি। গাঁথনি মজবুত করতে ব্যবহার করা হয়েছিল ডিমের কুসুম ও খয়ের জল। ওদের থেকেই জানতে পারি, প্যালেসের প্রত্যেকটি কোণে রয়েছে একটি করে সোনার ইট।
এই মিউজিয়াম প্রবেশ করতে হয় নিচের দরজা দিয়ে। ঢোকার মুখেই দেখা যায় ইংরেজদের ব্যবহৃত দু'পাশে দুটি টমটম গাড়ি, যার একটি টানতো দুটি ঘোড়াতে আর অপরটি একজোড়া উঁটে। এখান থেকে বেড়িয়ে আসতে হয় দরকার কক্ষের সামনের প্রকাণ্ড সিঁড়ি বেয়ে।
এই সিঁড়ি বেয়ে যখন বেড়িয়ে আসছি তখন সামনে দেখতে পেলাম একটি খোলা আঙিনা। যার মাঝখান দিয়ে একটি রাস্তা সোজা চলে গেছে ইমাম বাড়ার দিকে। এই রাস্তার ডানদিকে রয়েছে সুন্দর একটি বাগান। সেই বাগানের মাঝখানে রয়েছে ঘড়িঘর। অপরদিকে রয়েছে সিরাজের মদিনা। সিরাজদৌল্লার সময়ের একমাত্র নিদর্শন এটি। কথিত আছে মদিনার মাটি এনে এটি তৈরি করা হয়।
মদিনার সামনেই রয়েছে একটি সুবিশাল কামান, যার নাম বাচ্চাওয়ালী তোপ। অতীতে এই কামানটি একবারই দাগা হয়েছিল। এই কামান দাগার ফলে অনেক গর্ভবতী মা এর গর্ভপাত হয়। তাই এই কামানের এমন নামকরণ। পরবর্তী কালে এটি আর ব্যবহার করা হয়নি। এটি তৈরি করেছিলেন ঢাকার বিখ্যাত শিল্পী জনার্দন কর্মকার। এটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৮ ফুট ও এই কামান দাগতে ১৮ সের বারুদ লাগতো।
হাজার দুয়ারী প্যালেসের ঠিক উল্টো দিকেই দেখতে পেলাম বিখ্যাত ইমামবাড়াটি। বর্তমান এই ইমামবাড়াটি তৈরি করেন নবাব নাজিম ফেরাদুন জা। আগে এখানে সিরাজের তৈরি কাঠের ইমামবাড়া ছিল। এটি তৈরি করতে ব্যয় হয়েছিল তৎকালীন ৭ লক্ষ টাকা। প্রতি বছর শুধুমাত্র মহরমের সময়েই এটি জনসাধারণের জন্য খোলা হয়। মহরমের দিন এখনও এখান থেকে শোভাযাত্রা বের হয়। আয়তনে এই ইমামবাড়া ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইমামবাড়া। এই সবই আমরা জানতে পারি গাইড দাদার কাছ থেকে।
হাজার দুয়ারী ঘুরতে ঘুরতে আমরা দুজনেই খুব ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পরেছিলাম। তাই আর সময় নষ্ট না করে হাজারদুয়ারি চত্তর থেকে বেড়িয়ে পেছনের দিকে গঙ্গার ধারে থাকা খাবারের হোটেলে ঢুকে পড়লাম। ঢাকা হোটেলে ঢুকে পেট পুরে খেয়ে আমরা দুজনে একটি টোটো ভাড়া করে রওনা দিলাম মুর্শিদাবাদ স্টেশনের উদ্দেশ্যে। মিনিট কয়েক পরেই পৌঁছে গেলাম স্টেশনে। সেখান থেকে দুপুর ২.৩০ এর লালগোলা-রানাঘাট মেমু ধরে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশে।
আশা করি সকলের ভালো লাগবে। সকলে ভালো থাকবেন আর সকলকে ভালো রাখবেন।
ডিভাইস | ফটোগ্রাফার |
---|---|
ভিভো জেড ১ প্রো | pap3 |
(সমাপ্ত)
আপনি প্রতিটা বিষয় এত সুন্দর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিলেন যে আমি বাড়িতে বসেই যেন মুর্শিদাবাদ ভ্রমন করে নিলাম। এই ছবিগুলো দেখছি আর আশ্চর্য হচ্ছি যে সত্যিই সেই সময়েও কি অদ্ভুত সুন্দর ভাবে জিনিসগুলো তৈরি হয়েছিল।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
@pap3
পোস্ট সম্পর্কিত ট্যাগ গুলো ১ম এ দিবেন,এরপর অন্য ট্যাগ গুলো দিবেন।
ধন্যবাদ আপু। ঠিক করে নিলাম।
লালবাগ তাহলে গেলেন। এ তো আমার বোর্ডিং স্কুলের কাছে। খুব দারুণ একটা জায়গা। বহুদূরান্ত থেকে এই জায়গা লোকে আছে ঘুরতে। খুব ভালো লাগলো দেখে আপনি এই জায়গাটা খুব ভালোভাবে ঘুরেছেন এবং বর্ণনা করেছেন।
আপনার স্কুল কী নবাব বাহাদুর ইন্সটিটিউট?
আমি বহুবার লালবাগ গেছি। বারবার যাই। খুব ভালো লাগে।
লালবাগ জায়গাটা আসলেই খুব সুন্দর। এরকম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জায়গাগুলোতে ঘুরতে যেতে আমার কাছে খুবই ভালো লাগে। আপনি চমৎকারভাবে সম্পূর্ণ জায়গাটি সম্পর্কে আমাদের মাঝে তুলে ধরেছেন। এছাড়াও সে সময়ের অন্যতম নিদর্শন সিরাজের মদিনা এবং ঘড়িঘর দেখে সত্যি খুব ভালো লাগলো। সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম এই প্রাসাদের দরজার সংখ্যা শুনে। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি স্থান সম্পর্কে এত তথ্য ও ফটোগ্রাফি দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ আপনাকে। আসলে একে নিজের জেলা তার ওপর এতবার গেছি যে সব মুখস্থ হয়ে গেছে।
অনবদ্য ভ্রমণ কাহিনী।একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন সম্পর্কে সুবিস্তর বর্ননায় মনে হচ্ছে আমি নিজেই যেন ঘুরছি হাজারদুয়ারিতে।আর আয়নার ঘটনা পুলকিত করেছে,নিজেকে যেখা যায়না কিন্তু পাশের জনকে দেখা যায়!ভাল লিখেছেন।ভাল থাকবেন।
ধন্যবাদ আপু। যদি কখনো কলকাতা আসেন, একবার চেষ্টা করবেন মুর্শিদাবাদ ঘুরে যাওয়ার। নিজে ঘুরে দেখলে আরো আরো ভালো লাগবে।
২০১৫ তে কলকাতা গিয়েছিলাম অন্য কোথাও যাওয়া হয়নি।
এবার এলে মুর্শিদাবাদে ঘুরে যাবেন।
চেস্টা করবো।