মহাকুম্ভ। কিছু গল্প। কিছু বিজ্ঞান।
প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,
সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
[সোর্স](মেটা এ আই)


আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।
সনাতনী ধর্মের মানুষের মহাস্নানের তিথি, যেখানে দেশ বিদেশ থেকে নানান মানুষ সহ ভারতের সমস্ত নাগা সন্ন্যাসীদের ভীড় দেখা যায়। ২০২৫ সাল মহাকুম্ভের মহাসূচনা। জানুয়ারি মাসের তেরো তারিখ পৌষ-পূর্ণিমার দিন- আর চলবে ফ্রেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখ পর্যন্ত। সন্ন্যাসী, সাধু, যোগীদের থেকেও বেশি ভিড় সাধারণ মানুষের৷ এলাহবাদের প্রয়াগ এসবেরই সাক্ষী হয়ে থাকছে।
[সোর্স](মেটা এ আই)
কুম্ভমেলা প্রধাণত চার প্রকারের হয়৷ প্রতি তিন বছরে একবার করে হয় কুম্ভমেলা, প্রতি ছয় বছরে হয় অর্ধকুম্ভ মেলা, প্রতি বারো বছরে হয় পূর্ণকুম্ভ মেলা। প্রতি একশ' চুয়াল্লিশ বছর পর হয় মহাকুম্ভ মেলা। কুম্ভমেলার সম্পর্কে পুরাণ প্রচলিত কথায় ঢুকে পড়ার আগে বলি কুম্ভ'র অর্থ। না, কুম্ভ'র অর্থ কোন রাশি নয়, কুম্ভ হল কলসি বা কলস বা ঘট। সেই ঘট যার মধ্যে সমুদ্রমন্থনের সময় ধন্বন্তরির হাতে করে উঠেছিল অমৃত। কি এই অমৃত? অমর হওয়ার বিশেষ তরল, নাকি সোমরস? প্রসঙ্গত বলে রাখি অমৃতরস যদি সোমরসও হয় তাহলে সোমরস কিন্তু অ্যালকোহল জাতীয় কোন বিশেষ পানীয় নয়। এবং এই কথা আমার নয়। ঋকবেদে সোম এর কথা উল্লেখ রয়েছে। আমেরিকান লেখক আর, জর্ডন ওয়াসন এর লেখা সাড়া জাগানো বই দ্য ডিভাইন মাশরুম বইতে ছবি সহ উল্লেখ আছে এক আলোকিত মাশরুমের। যা হিমালয়ের পাদদেশে এক প্রকার মাশরুম পাওয়া যায়, রাত্রি হলে এই মাশরুমের গা দিয়ে অদ্ভুত আলো বিচ্ছুরিত হয়। এই বিষয় নিয়ে এবং বইটি নিয়ে অনেক কনফারেন্স হয়েছে, এবং অনেক ভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে এই মাশরুমের রসই সোমরস, যা চিকিৎসা বিজ্ঞান জগতে সাড়া ফেলানো৷ তবে অবশ্যই অমরত্ব লাভ নয়। তবে কেন অমৃত অমরত্ব বিষয়ক তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়৷
যদি অমরত্ব লাভের রস অমৃত নয় তাহলে কেন সেই অমৃত নিয়ে এতো লড়াই?
[সোর্স](মেটা এ আই)
নানান প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে যে কথা স্পষ্ট হয় আমাদের এক একটা পুরানে এক এক ধরণের ব্যাখ্যা। শিব পুরান থেকে পদ্মপুরান রামায়ণ মহাভারত এবং হরিবংশ, সবেতেই যেভাবেই হোক, অতিরঞ্জিত করে হলেও সমুদ্র মন্থনের ঘটনার উল্লেখ আমরা পাই৷ অর্থাৎ কিছু একটা ঘটেছিল, হয়তো তা কলস মন্থন কিংবা সমুদ্র। হতে পারে কলসকেই বৃহদাকারে সমুদ্রে বর্ণনা করা হয়েছে৷ তবে যেমনই হোক আবারও বলছি মন্থন হয়েছিল। এবং তাতে উঠে এসেছিল নানান বস্তু৷ সমুদ্র মন্থন ধরে এগোলে দেখা যায় মন্থনে প্রথম উঠেছিল ঘি, যা কি না আয়ুর প্রতীক। আয়ু বাড়ায় কিংবা কমায় সেই বিতর্কে না গিয়েও অনায়াসে বলতে পারি ঘি আমাদের শরীরের পক্ষে আসলেই কত উপকারী এবং আমাদের কত রোগ থেকে মুক্ত করে। এভাবেই একের পর এক জিনিস ওঠার পর ধন্বন্তরির হাতে এলো অমৃত কলস৷ এই জায়গায় আমার মনে হয় দৃষ্টিপাত অমৃত কলসের দিকে দেওয়ার আগে আমাদের ধন্বন্তরির দিকে দিলে বাকি বিষয়টা সহজ হয়ে ওঠে৷ ছোট্ট একটা প্রশ্ন ধন্বন্তরি কে?
ভারতবর্ষ আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বহু যুগ আগে থেকেই অনেক অনেক উন্নত। এবং ভারত থেকেই এই আয়ুর্বেদ চিকিৎসা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এই আয়ুর্বেদ যার হাতে জন্মেছিল তিনিই হলেন ধন্বন্তরি৷ পুরান মতে দেবতাদের ডাক্তার ধন্বন্তরি। বর্তমানেও তাকেই মান দিয়ে কোন ডাক্তার অবিশ্বাস্য সাফল্যের দিকে এগিয়ে গেলে আমরা বলি ধন্বন্তরি ডাক্তার৷ আসলে পুরানের ওই ধন্বন্তরিকেই উদাহরণ হিসেবে নিয়ে আসি। এখন কথা হচ্ছে আয়ুর্বেদের জনকের হাতে অমরত্বের রস উঠল? আবার অমরত্বের রসই যদি ওঠে তবে ডাক্তার ধন্বন্তরির কি প্রয়োজন? একটু তলিয়ে ভাবলেই স্পষ্ট হয়, মন্থনের ফলে আসলেই সমুদ্রতলদেশ থেকে নানান ধরণের আয়ুর্বেদিক ঔষধি উঠে আসে৷ যা পরবর্তীতে চিকিৎসা শাস্ত্রের বিশাল উন্নতির অভিমূখ হয়ে দাঁড়ায়৷ খুব সাধারণ ভাবেই যদি আমরা মন্থনের কথা ভাবি, কলসিতে দুধ দিয়ে মন্থন করলে ফ্যানা ওঠে তারপর মাখন ওঠে। তেমনি সমুদ্র এতো বড় তট মন্থন হল৷ সেখানে তলদেশ থেকে নানান উদ্ভিদ বা অন্য কিছু উঠে আসবে এটাই স্বাভাবিক। মহাভারতের পরবর্তীকালের রচনা হরিবংশ নাড়াঘাঁটা করে আমার এইটুকুই বিজ্ঞান সম্মত মনে হয়েছে। এর পেছনে যদিও আরও একটা যুক্তি আছে, হয়তো বা কাকতালীয়৷ তাও, যেকোনো আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা কেন্দ্রে যদি ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায় তাহলে আমরা এমন কোন পাত্র বা হামানদিস্তার মত দেখতে জিনিস পাই যার মধ্যে একটি মন্থন দণ্ড থাকে। আয়ুর্বেদিক ওষুধগুলো ওই মন্থন দ্বন্দ্বের সাহায্যে এখন ধরে মন্থিত করা হয় এবং পরবর্তীতে তা মধুর সাথে মিশিয়ে খাইয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ বলা যায় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে মন্থন দন্ডের জায়গা উল্লেখযোগ্য৷
এই ব্যাখ্যা ছাড়াও যদি আমরা আরো একটু অন্যরকম ভাবে ভেবে দেখতে চাই তাহলে বলবো কুম্ভ অর্থাৎ কলস কে উল্টে দেখতে। কলস উল্টে দিলে যে আকৃতি তৈরি হয় সেই আকৃতি হল আমাদের গলা সমেত মাথা। খুব একটা ভুল বলছে কি? ছোটবেলার একটি কথা মনে পড়ে, যখন কোন নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছি তখনই বাড়ির কোন গরুজন বা শিক্ষক মশাইরা বলতেন "তোর ঘটে কি আছে"। ঘট অর্থে কলসি অর্থে কুম্ভ। সেক্ষেত্রে মাথাকে কুম্ভ হিসেবে উল্লেখ করা যেতেই পারে। সমুদ্র মন্থনের পর হতেই পারে আমাদের মাথা অর্থাৎ বুদ্ধি উঠে এসেছিল। যাকে কাজে লাগিয়ে আমরা ক্রমশ উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছি এবং নিজেদের ছাপ যুগের প্রতিটা ধাপে ভালোভাবে রেখে দিতে সক্ষম হচ্ছি। মানুষ কখনোই অমর নয়, অমর তার কাজ তার সৃষ্টি। আর যে সৃষ্টি যুগের পর যুগ ধরে থেকে যায় সেই সৃষ্টিই কিন্তু স্রষ্টা কে অমরত্ব দিয়ে থাকে। তাহলে সমুদ্র মন্থনে কুম্ভের ভেতর যা উঠেছিল তা অমৃত যদিও হয় তবে তা সঠিকভাবে কাকে প্রতিনিধিত্ব করেছিল?
[সোর্স](মেটা এ আই)
কোথাও কি মনে হয় না, এই বিপুল আবিষ্কারকেই উদযাপন করতে বহু বছর ধরে কুম্ভ মেলার আয়োজন। আর সেই মহা আয়োজনে সেই সমস্ত সন্ন্যাসীদের আগমন হয় যাদের আমরা সাধারণ জনজীবনে দেখতে পাই না যারা নিভৃতে প্রাচীন আবিষ্কার, জ্ঞান ও নিজেদের জানার উদ্দেশ্যে সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন। তবে কি যারা কুম্ভে আসেন তাঁরা সকলেই এমন? না তা নয়, গঙ্গায় তো কতই বেনো জল আছে তাও তো গঙ্গাকেই আমরা বিশুদ্ধ জল মানি৷ সাধু সন্ন্যাসীরাও অনেকটা সেরকম।
কুম্ভ মেলা আসলেই সকলের বা জনসাধারণের জন্য নয়। কিন্তু বর্তমানে হুজুগে পৃথিবীবাসী সকলেই রাতারাতি পূন্যস্নানের লোভে ছুটছেন। এভাবেই কি জীবনের পাপ ধুয়ে ষোলকলা পূন্যে পূর্ণ করা যায়?

পোস্টের ধরণ | লাইফস্টাইল ব্লগ |
---|---|
ছবিওয়ালা | নীলম সামন্ত |
মাধ্যম | স্যামসাং এফ৫৪ |
লোকেশন | পুণে,মহারাষ্ট্র |
ব্যবহৃত অ্যাপ | ক্যানভা, অনুলিপি |
১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে
~লেখক পরিচিতি~
আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশ ও ইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
X-promotion
বেশ কিছুদিন ফেসবুকে কুম্ভ মেলা নিয়ে অনেক পোস্ট দেখছি। ১৪৪ বছর পর এই বছর মহা কুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।মহাকুম্ভুের বিষয়ে অনেক কিছুই ফেসবুক থেকে শুনেছি। তবে দিদি আপনার পোষ্টের মাধ্যমে অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম। মহাকুম্ভ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা অনেক ভালো লাগলো দিদি। আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।
চেষ্টা করলাম নিজের বোঝাগুলো অক্ষরের হার ধরে প্রকাশ করতে। ধন্যবাদ আপু। পুরোটা পড়লেন আর মন্তবও করলেন। খুশি হয়েছি।
কুম্ভ মেলা বিষয়ক ভীষণ সুন্দর একটি তথ্য সম্বলিত পোস্ট ব্লগের মাধ্যমে শেয়ার করেছিস দেখে ভালো লাগলো। কুম্ভ নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। আর যেহেতু এই বছর এটি পূর্ণ কুম্ভ ছিল তাই প্রচুর পরিমাণ মানুষ পৌঁছে গিয়েছিল সেই মেলায়। তাই কুম্ভর এত সুন্দর করে ডিটেল পোস্ট করলি বলে ভীষণ ভালো লাগলো।
এবারে যা ছিল তা যে কি ছিল আমি নিজেও বুঝিনি তবে মানুষের ভিড় দেখেই কুম্ভ সম্পর্কে জানার ইচ্ছে হয়েছিল। আর জানোই তো যা জানতে চাই তার ভেতরে না ঢুকে আমার শান্তি নেই।