কমলাইলিশ || বাঙালির সেরার সেরা মাছ ইলিশ ও শীতের কমলালেবুর যুগলবন্দী।
প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,
সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।
আনিয়া ইলিশ মৎস্য করিল ফালা ফালা
তাহা দিয়া রান্ধে ব্যঞ্জন দক্ষিণ সাগর কলা।
মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যে বাঙালার খাবার দাবার রন্ধন সম্পর্কিত অনেক তথ্যই পাই৷ বিজয়গুপ্ত তাঁর কালজয়ী রচনা পদ্মপুরাণে ওপরের লাইনগুলি লিখেছেন। আমিষ পদগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ইলিশের ঝোল। তারপর থেকে দিন যত গেছে ইলিশের কদর বেড়েছে বৈ কমেনি। বিভিন্ন তথ্যসুত্র বলছে, ১৯১৬ সালে বহরমপুরের কাশিমবাজার রাজবাড়িতে মহারাজা শ্রীশচন্দ্র নন্দীর বৌভাতে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। প্রায় দু'শ রকমের পদ ছিল। সে যুগে একটা বৌভাতে এতো রকমের পদ কিন্তু খুব কম নয়৷ ওই দু'শ পদের মধ্যে দুটি পদ ইলিশের ছিল। আমেলিশ সার্ষপং অর্থাৎ ইলিশের সরষে বাটা আর ইলিশ পত্রিকা অর্থাৎ ইলিশমাছের পাতুড়ি। এই দুই পদ আজও আমাদের বাঙালিদের কাছে রাজকীয় পদ হিসেবেই গুরুত্ব পায়৷
বাঙালির ইলিশকে নিয়ে আদিখ্যেতার অন্ত নেই৷ অনেক বনেদিবাড়িতে বছরের প্রথম ইলিশ বাড়িতে এলে তার আঁশ মাটির তলায় পুঁতে রাখা হত, এতে করে নাকি গৃহস্থের অর্থের আগমন বাড়বে। কোন কোন বাড়ির প্রথা অনুযায়ী দূর্গা নবমী বা দশমীর দিন জোড়া ইলিশ রান্নার প্রথা আছে৷
জানেন বর্ষাকালে ইলিশের আগমন নিয়ে দারুণ গল্পও আছে। আষাঢ়ের মেঘ যখন ঘন হয় আর ঝমঝমিয়ে বৃষ্ঠিতে গঙ্গা পদ্মা ফুলে ওঠে, তখন স্বামীর সোহাগে ইলিশ বৌয়ের পেটে সন্তান আসে৷ বৃষ্টির বেগ মাথায় নিয়েই পোয়াতি ইলিশ মিষ্টি জলে আসে সন্তান জন্ম দিতে। মা গঙ্গা ও মাসি পদ্মার স্রোত সামলেই ডিম পাড়বে৷ সন্তান বড় করে আবার ফিরে যাবে৷ গঙ্গা পদ্মায় ইলিশ বছরে দু'বার আসে। বর্ষাকালে আর শীত কালে। কৃষ্ণা নদীতে আসে আশ্বিনের শুরুর দিকে। কার্তিক মাসে প্রথমে ইলিশ-বর-বৌ এক সাথে আসে গোদাবরী আর ইরাবতীতে।তারপর একেবারে ফাল্গুন-চৈত্রে আসে সিন্ধু নদে৷ এই সমস্ত মিঠা জলে যাতায়াতের কারণেই ইলিশকে উজানবাহী বলা হয়।
ইলিশের সুগন্ধ আর মাঝে মাঝে আসা যাওয়ার কারণেই হয়তো এতো কদর। কোথাও কোথাও আবার গুরুবাড়িতেও ইলিশ পাঠানোর চল আছে। এই সব কিছুই কাউকে বেশি মাত্রায় গুরুত্ব দেওয়ার কারণ বলেই আমার মনে হয়। আমাদের বাড়িতে ইলিশ নিয়ে এরকম কোন প্রথা নেই। ছোট থেকে দেখেছি প্রতি বছর বাজারে যতদিন ইলিশ আসত বাবা রোজ কিনে আনতেন। কোলাঘাটে ছোটমাসির বাড়ি এবং রূপনারায়ণের খানিকটা চড়া ওদের হওয়ার কারণে আমার মেসোমশাই জেলে মাঝিদের থেকে প্রতি বছরই ইলিশ নিয়ে পাঠাতেন। সেই ইলিশের স্বাদ এখন আর পাওয়া যায় না। এবছর দাদা পাঠিয়েছিল ইলিশ। তারপর আর খাওয়া হয়নি। মুম্বাইতে অনেক ইলিশ আসত। পুনেতেও আসে কিন্তু দোকানগুলো কোথায় তা এখনও জানি না৷ গত সপ্তাহে মাছের আড়তে দেখলাম ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। সাইজ ছোট হলেও তা ইলিশই। জিজ্ঞেস করতে বলল গুজরাটের। দুটোই নিয়ে এসেছিলাম, তবে গোটা। আমি বাড়িতে কেটেছি নিজের মতো করে। মারাঠিরা কি আর বাঙালির মতো মাছ কাটতে পারে? ছাল চামড়া তুলে ইলিশ যখন ওদের হাত থেকে বাড়ি আসে তখন আর একেবারেই চেনা যায় না৷
সেই ইলিশের সরষেবাটা হয়েছে, একদিন তেঁতুল দিয়ে টক খেলাম। কিন্তু বরাবরই কিছু এক্সপেরিমেন্ট করতে আমার ভালো লাগে। গতকাল বাবা এসেছেন। বাবা আমার কাছে এলে এতোই জিনিসপত্র আনেন কোনটা ছেড়ে কার কথা বলব নিজেই খুঁজে পাই না৷ যাইহোক অনেক নাগপুরের কমলালেবু এনেছিলেন। এই সময় নাগপুরের কমলালেবু খুব মিষ্টি হয়, এছাড়াও আলাদা গন্ধ ও স্বাদ থাকে। ইলিশ ভাজতে তুলে দিয়ে ভাবলাম কমলালেবু দিয়ে ইলিশ মাছ রান্না করলে কেমন হবে? বাবা মজা করছিলেন খেতে পারবেন নাকি ভেবে৷ আমি আশ্বস্ত করলাম, বললাম এতোদিন রান্না করছি এটুকু তো বুঝিই কিসে কি দিলে স্বাদ কেমন হবে৷ খাওয়ার সময় সবাই বেশ চেটেপুটেই খেয়েছে। তাই ভাবলাম আপনাদের সাথে রেসিপি শেয়ার করি।
চলুন দেখে নিই কি কি লেগেছে।
- ইলিশ মাছ — ৪ পিস
- কালোও হলুদ সরষে মিলিয়ে — প্রায় ৩ চামচ
- কালো জিরে — হাল্ফ চা চামচ
- কাঁচা লঙ্কা — ২ টা
- কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো — ১ চামচ
- নুন হলুদ— পরিমান মতো
- কমলালেবু — মাঝারি সাইজের ২ টা
চলুন দেখে নিই কিভাবে বানালাম।
নুন হলুদ মাখিয়ে, কড়ায় সরষের তেল গরম করে মাছগুলো দিয়ে দিয়েছে। খুব বেশি ভাজব না, সামান্য এপিঠ ওপিঠ করে নেব।
মাছ ভাজা হওয়ার ফাঁকে সরষে বেটে নিলাম।
দুই পিঠ ভেজে ওই তেলেই কালো জিরে ও কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিলাম।
~ এবার সরষে বাটা দিয়ে দিলাম।
~ ওপর থেকে কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে দিলাম। সামান্য নুনও দিয়েছি। এই সময় আর হলুদ দিইনি৷ কারণ এই লাল লঙ্কার গুঁড়োই কমলালেবুর সোনালী রঙ এনে দেবে।
** অল্প পরিমাণ জল মিশিয়ে দিলাম, এবার এটি কেক সামান্য কিছুক্ষণ ফুটিয়ে নিচ্ছি।**
** একটা লেবু এভাবে মাঝ বরাবর কেটে হাফ করে নিয়েছি৷ আর বীজগুলোও বেছে ফেলে দিয়েছি। আর একটা লেবু মাঝখান থেকে দুটো স্লাইস কেটে আলাদা করে নিয়েছি।**
দুটো স্লাইস ছাড়া বাকি সব লেবুর রস নিঙড়ে সরাসরি মাছ ও সরষে বাটার উপর দিয়ে দিলাম।
লেবুর রস নিংড়ে দেওয়ার পর, কমলা লেবুর দুটো স্লাইস এইভাবে ঝোলের মধ্যে দিয়ে ভালো করে ফুটিয়ে নিয়েছি।
প্রয়োজন মত রস রেখে কড়াই নামিয়ে নিয়েছি, আর সাথে কমলা ইলিশ রান্নাও শেষ হল।
আচ্ছা, আবার আগামীকাল আসব নতুন কোন পোস্ট নিয়ে। ততক্ষণ আপনারা ভীষণ ভালো থাকুন আনন্দে থাকুন। আজ এ পর্যন্তই...
টাটা
পোস্টের ধরণ | রেসিপি পোস্ট |
---|---|
ছবিওয়ালা | নীলম সামন্ত |
মাধ্যম | স্যামসাং এফ৫৪ |
লোকেশন | পুণে,মহারাষ্ট্র |
ব্যবহৃত অ্যাপ | ক্যানভা, অনুলিপি, ইনশট |
১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে
~লেখক পরিচিতি~
আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশ ও ইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।
খুবই মজাদার রেসিপি তৈরি করেছেন। ইলিশ মাছের এই সুস্বাদু রেসিপি খেতে ইচ্ছা করছে। ধাপে ধাপে মজাদার রেসিপি শেয়ার করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
চেষ্টা করেছি দাদা। আপনার ভালো লেগেছে শুনে আনন্দিত হলাম। ধন্যবাদ জানবেন৷
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
https://x.com/neelamsama92551/status/1863248027579801977?t=SixxfgR128kUy2LCI_J8oA&s=19
ইলিশ সম্পর্কে কতো দুষ্ট মিষ্টি কথা বল্লে আমি মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। মেসমশাই অনেক কিছু এনেছে বাবাদের কাজ এটাই মেয়ের বাড়িতে দুনিয়ায় সব জিনিসপত্র নিয়ে আসলেও তৃপ্ত হন না।দারুণ রেসিপিটি হয়েছে। এই রেসিপি কখনো খাওয়া হয়নি তবে রেসিপি টি দেখে লোভ লেগে গেলো। কমলা লেবু দিয়ে রান্না করার জন্য ইউনিক ও লোভনীয় হয়েছে রেসিপিটি। ধাপে ধাপে রন্ধন প্রনালী চমৎকার সুন্দর করে আমাদের সাথে ভাগ করে নিয়েছেন। ধন্যবাদ আপনাকে লোভনীয় রেসিপিটি আমাদের সাথে ভাগ করে নেয়ার জন্য।
সব কিছুরই গল্প আছে গো। আমি চেষ্টা করি সেগুলোই তুলে আনতে৷ তুমি পড়লে, তোমার ভালো লাগল জেনে আমিও খুশি হলাম। এইটে আমার লেখার পুরষ্কার৷
দারুন একটা রেসিপি শেয়ার করেছেন। এই রেসিপিটা একদম ইউনিক লেগেছে আমার কাছে। তার পাশাপাশি কিছু কথা শেয়ার করেছেন যেগুলো জানা ছিল না। ধন্যবাদ এত সুন্দর কিছু কথা এবং রেসিপিটা উপস্থাপন করার জন্য।
আপনাকেও ধন্যবাদ, পোস্টটি সময় নিয়ে পড়েছেন। অনেকটা ভালোলাগা ও শুভেচ্ছা জানালাম। ভালো থাকবেন আপু।
ইলিশ মাছ এর বেশ কিছু তথ্য জানা হলো আপনার পোস্টের মাধ্যমে।বেশ ভালো লাগলো তথ্যগুলো জানতে পেরে। আপনার রেসিপিটি জাস্ট অসাধারন হয়েছে।দেখেই মনে হচ্ছে বেশ মজার ছিল রেসিপিটি। একদিন বানিয়ে খেতে হবে। মজার রেসিপিটি শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
অবশ্যই বানিয়ে খাবেন। ভালোই লাগবে৷ আমার তো বেশ ভালো লেগেছিল।
আপনি একদম ঠিক বলছেন দিদি আমরা বাঙালিরা ইলিশ মাছ অনেক বেশি পছন্দ করি। বিশেষ করে বাঙালিরা এমনিতেই মাছে ভাতে বাঙালি। তার মাঝে যদি এত সুস্বাদু মাছ হয় তাহলে বলেন কে এড়িয়ে যেতে পারে। আমার তো এমন ভাজা ইলিশ সরিষা পোস্ত দানা দিয়ে রান্না করলে খেতে খুবই ভালো লাগে। দারুন একটি স্বাদের রেসিপি আপনি আজকে আমাদের সাথে শেয়ার করলেন। অনেক ভালো লেগেছে আপনার রেসিপিটি দেখে।
আমি এরকম নিত্যনতুন রান্নার রেসিপি মাঝে মধ্যেই করি৷ এখানেও শেয়ার করি মাঝে মাঝে। আপনি আমার এই রেসিপিটি পড়লেন এবং সুন্দর করে মন্তব্য করলেন বলে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।
নতুন একটি রেসিপি দেখতে পেলাম।সবাই চেটে পুটে খেয়েছেন।তার মানে রেসিপিটি খুব স্বাদের হয়েছিল খেতে।নতুন নতুন রেসিপি করতে সত্যি ই ভালো ই লাগে।বাবা খেয়ে তৃপ্তি পেয়েছেন শুনে আরো ভালো লাগলো।
হ্যাঁ আপু, বাবাকে তো আমি কমই পাই৷ বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকি তো। তাই বাবা এলে যত্ন করি৷ আসলে আমিও ভয় পাই, কোন একদিন তো বাবা আর থাকবে না। তখন ইই করব চাইলেও কিচ্ছু করতে পারব না। 😔
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যগুলো ক্যামেরাবন্দি করে মোবাইলে রাখতে আমার কাছে অনেক ভালো লাগে। আপনি ঠিক তেমনি অসাধারণ সব ফটোগ্রাফি করেছেন। আপনার ধারণা করা প্রত্যেকটা ফটোগ্রাফি আমাকে মুগ্ধ করলো। আমি মনোযোগ সহকারে শুধু দেখলাম চেয়ে চেয়ে দেখার মত চিত্রগুলো।
আপনি সম্ভবত ভুল পোস্টে কমেন্ট করে ফেলেছেন। এটি রান্নার পোস্ট আর আপনি কোন ফটোগ্রাফির পোস্টে কমেন্ট করেছেন।