"শৈশবে শীতের সন্ধ্যায় কানামাছি খেলার গল্প"
দুপুর থেকেই মনে শুরু হতো উত্তেজনা। খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই শীতের পিঠা খেতে বসতাম। মা, খালা, আর দাদিরা তখন পিঠা বানাতে ব্যস্ত থাকতেন, আর আমরা ছোটরা নিজেদের পরিকল্পনা নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকতাম। সন্ধ্যা হতেই মামাতো আর খালাতো ভাইবোনেরা জড়ো হতো উঠোনে। মাথায় মাফলার, গায়ে সোয়েটার, আর পায়ে পুরোনো গরম স্যান্ডেল; সবার সাজটাই যেন এক রকম ছিল। বড়দের কাছ থেকে কেরোসিনের ল্যাম্প নিয়ে আমরা উঠোনটা আলোকিত করতাম।
খেলার শুরুর আগে ঠিক করা হতো, কে প্রথমে কানামাছি হবে। লটারির মতো আমরা হাতের আঙুল ব্যবহার করে কাউন্ট করতাম। যিনি হেরে যেতেন, তার চোখে আমরা রুমাল দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিতাম। রুমালের গিঁট বাঁধতে গিয়ে হাসাহাসি আর দুষ্টুমির কোনো শেষ থাকত না। চোখ বাঁধা হলে প্রথম কয়েক সেকেন্ড তার মধ্যে ভয় মিশ্রিত উত্তেজনা দেখা যেত। আর বাকিরা মজা পেতে কৌশলে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে গানের সুরে বলতে শুরু করতাম:
"কানামাছি ভোঁ ভোঁ,
যার পেছনে পড়বি, সে বলবে ধোপ!"
উঠোনটা ছিল মাঝারি আকারের। একদিকে বড় তেঁতুল গাছ, অন্যদিকে হাঁড়ি-পাতিল রাখা লাল মাটির বারান্দা। আমরা সবাই নিজেদের লুকানোর জায়গা ঠিক করতাম গাছের পেছনে বা বারান্দার কোণে। চোখ বাঁধা সঙ্গী যখন তার হাত বাড়িয়ে কাউকে ধরতে চাইত, তখন তার চারপাশে ঘুরে আমরা জোরে জোরে হাসতাম। এই হাসিগুলোই তাকে বিভ্রান্ত করত।
একবার আমার খালাতো ভাই রাশেদ চোখ বাঁধা অবস্থায় বারান্দার দিকে চলে গেল। আমরা তখন অন্য পাশে চলে গেলাম। সে বারান্দার কোণে হাঁড়ি-পাতিলে ধাক্কা লাগিয়ে এমন মজার ভঙ্গিতে পড়ে গেল যে সবাই হেসে লুটোপুটি খেতে লাগলাম। আমাদের হাসির শব্দে নানি এসে বললেন, “আর খেলবি না, ওষুধ লাগাই।” কিন্তু আমরাই বা থামি কী করে? একটু বিরতি দিয়ে আবার শুরু করলাম।
শীতের সন্ধ্যায় খেলার মজাটাই ছিল আলাদা। ঠান্ডা বাতাসে মুখ লাল হয়ে যেত, হাত-পায়ে শীতল অনুভূতি নিয়ে ছুটোছুটি করতাম। দূরে কোথাও বাঁশির সুর ভেসে আসত। মাঝে মাঝে মাটির চুলো থেকে ভেসে আসা ধোঁয়া আর মিষ্টি পিঠার গন্ধ আমাদের আরো প্রাণবন্ত করে তুলত। শীতের কম্বল আর লেপের অপেক্ষা ভুলে যেতাম আমরা। সেই মুহূর্তে যেন শীতের সব কষ্টকেই জয় করে ফেলতাম।
খেলার মধ্যে মাঝেমধ্যে ছোটখাটো ঝগড়া লেগে যেত। কেউ যদি কানামাছি না হতে চাইত, তবে বাকিরা জোর করে তাকে দাঁড় করিয়ে দিত। একবার আমার মামাতো বোন জুঁইয়ের সঙ্গে এই নিয়ে খুব ঝগড়া হয়। সে কানামাছি হতে রাজি না হওয়ায় সবাই মিলে তাকে বকাঝকা করি। পরে দাদি এসে আমাদের শান্ত করে আর বললেন, "খেলাধুলা মানেই মজা। কেউ রাগ করবে না।" দাদির এই কথায় সবার মুখে আবার হাসি ফুটে ওঠে।
খেলা শেষে সবাই ঘেমে-নেয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতাম। তখন ঠান্ডা হাত দিয়ে কেউ একজন আরেকজনকে ভয় দেখাতো। মায়েরা ডাক দিতেন, “এসো, খেতে এসো।” গরম ভাত আর মুরগির ঝোল খেতে খেতে খেলাধুলার গল্প চলত। কখনো কেউ বলত, "আজ আমি সবার থেকে ভালো লুকিয়েছি।" আবার কেউ বলত, "আমার চোখ বাঁধা অবস্থায় সবাই আমাকে ধোঁকা দিয়েছে।"
আজ এত বছর পর শৈশবের সেই শীতের সন্ধ্যাগুলো খুব মনে পড়ে। কানামাছি খেলার সেই হাসি, দুষ্টুমি, আর উচ্ছ্বাস যেন হারিয়ে যাওয়া এক রাজ্যের মতো। সময়ের স্রোতে সবাই এখন ব্যস্ত। কেউ বিদেশে পড়াশোনা করছে, কেউ চাকরিতে। সেই উঠোনটা আর নেই, সেই শীতের সন্ধ্যার কানামাছি খেলার পরিবেশও নেই। কিন্তু মনের গভীরে সেই স্মৃতিগুলো আজও অমলিন।
শৈশবের সেই শীতের সন্ধ্যাগুলো আমাদের জীবনের এক অমূল্য ধন। সেসব স্মৃতি আজও মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেয় আর বলে যায়, “ফিরে যাও শৈশবে, যেখানে ছিল শুধুই হাসি আর খেলা।”
আজ এখানেই শেষ করছি। অন্য কোন একদিন ভিন্ন ধরনের কনটেন্ট নিয়ে আপনাদের মাঝে হাজির হব। ততক্ষন পর্যন্ত আপনারা সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।
0.00 SBD,
0.01 SP
X-Promotion
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
আসলে ভাইয়া শৈশব আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এমন একটি সময় যা কখনো চাইলেও আমরা মুছে ফেলতে পারব না। আর সে সময়ের সব স্মৃতি গুলো আমাদের সেই দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আপনার শৈশবের কানামাছি খেলার স্মৃতিগুলো পড়ে আমারও ছেলেবেলার কানামাছি খেলার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আমিও আপনার মত ছেলেবেলায় এ খেলাটা খেলতাম।
প্রচন্ড শীতের দিনে আমরা ফসলের মাঠে ক্রিকেট খেলতাম। কুয়াশা ঘিরে আসতো। পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজনরা মানা করতো ফাঁকা মাঠে বাতাস হচ্ছে খেলতে যাস না। তবুও খেলতাম। প্রচন্ড গা ঘেমে যেত। এরপর এসে গোসল করতাম। হয় টিউবওয়েলে অথবা পুকুরে। আপনার এই খেলার বিষয়টা পড়তে গিয়ে যেন সেই দিনের কথাগুলো মনে হলো।
শৈশব হলাম একটি মানুষের জীবনের ফেলে আসা সব থেকে রঙিন অধ্যায়। শৈশব কে কখনো ভোলা যায় না। আপনারা শৈশবে শীতের সময় খুব মজা করে কানামাছি খেলতেন। আমরাও কানামাছি খেলতাম তবে শীতকালে খুব একটা খেলা হতো না। শীতকালে সন্ধ্যে হলে অল্প একটু পড়াশোনা করে লেপের মধ্যে ঘুমিয়ে যেতাম। আপনার শৈশবে কাটানো কানামাছি খেলার মুহূর্ত পড়ে ভালো লাগলো। সুন্দর একটি পোস্ট আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। যা কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। জীবনের চলার পথে স্মৃতিগুলো প্রতিনিয়।আমাদেরকে ছেলেবেলার সেইসব ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। আপনি আজ বেশ সুন্দর একটি ছেলেবেলার স্মৃতি আমাদের সাথে শেয়ার করেছেন। ধন্যবাদ ভাই আপনাকে।
শৈশবকালের স্মৃতি গুলো সত্যি অসাধারণ। কানামাছি খেলার মুহূর্তগুলো আমার দারুন লেগেছে। আপনার গল্পটি পড়ে সেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল।