আমার ক্যামেরাবন্দী ঢাকা শহর

ঢাকা শহরে কোনোকিছু ঠিক সময়ে থাকে না। যেমন ধরুন আপনি ভাববেন রমনা থেকে ফকিরাপুল আধঘন্টায় পৌঁছে যাবেন। বেরোলেনও সেই হিসাব করে। কিন্তু ব্যাস। বাধ সাধলো রাস্তা। অর্থাৎ যানজট। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। ঘন্টার পর ঘন্টা অনায়াসে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন লক্ষ লক্ষ বাঙালী। আহা রে৷ এই স্বজাতিই কিনা কলকাতা শহরে ১০ মিনিট সিগনালে বাস দাঁড়ালে কম করে সাড়ে তিনবার পাশের সহযাত্রীকে বিনামূল্যে বিরক্তির ফলাফল পরিবেশন করেন। কী বিচিত্র এ পৃথিবী, থুড়ি বাঙালী। একা একা চড়ে বেড়িয়েছি ঢাকা শহর। কীই না করলাম। খাঁচার মত সি এন জি চাপলাম (কলকাতার পোশাকি ভাষায় অটো), রাজপথে ভিড় ঠেলে হাঁটলাম, লোভনীয় মোরগ পোলাও খেলাম, রিক্সা চাপলাম, আরো কত কি। আপাতত ইতিহাসের শিকড়গুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করিনি। সময় বড় কম হাতে৷ পুরো শহরটা চড়ে বেড়াতে গেলে যে সময় দরকার, তার বিন্দুবিসর্গ ছিল না। আর তার মধ্যে বিস্তর কাজ। ঢাকার বন্ধুবান্ধব পাঠকদের সাথে দেখা করার চাপ৷ বিশ্রাম স্বপ্নে। যাওয়া থেকে ছুটে গেছি। শুধু কয়েকটা বিষয় যে ভাবায়নি না তা নয়। সারা দুনিয়ায় বাঙালীর একান্ত নিজের মহানগরী দুটোই৷ কলকাতা আর ঢাকা। ফরাসীদের প্যারিস আছে৷ আর বাঙালীর আছে ঢাকা, কলকাতা। কিন্তু আদপকায়দায় বিস্তর ফারাক। ঢাকা শহরে জিনিসপত্রের দাম তুঙ্গে৷ বাংলাদেশের অর্থনীতির সাথে তাল মেলাতে মেলাতে এই মেট্রোরও হাঁপিয়ে ওঠার জোগাড়। কিন্তু শহরটা আদ্যোপান্ত বাঙালী। অর্থাৎ ধরুন আপনি বাসে উঠে বাংরেজি অভ্যাসে জিজ্ঞাসা করলেন আচ্ছা ভাই সামনের হল্ট কোথায়? তাতে উত্তর আসতে পারে - মানে যাত্রাবিরতি জিজ্ঞাসা করছেন? আবার ধরুন কলকাতার লাগেজ বলতে অভ্যস্ত অর্ধ অ্যাংলো বাঙালি সম্প্রদায় হঠাৎ করে সেদেশে শুনতে পারেন "স্টপেজ এসে গেছে মালামাল নিয়ে নেমে পড়ুন"। এই উত্তরগুলো আমার ক্ষেত্রেই এসেছে। তবে আর বলছি কী। দেশের নোটে সিরিজ নাম্বার বাংলায় থেকে শুরু করে গাড়ির নাম্বারে আদ্যোপান্ত বাংলায় ঢাকা মেট্রো - ক, ঢাকা মেট্রো - চ অথবা ঢাকা মেট্রো - ঢ, এমন আরো অনেক সিরিজ। এখানে বাংলা ভাষার ওপর গলা টিপে ধরতে আসা হিন্দী আর ইংরাজি অহেতুক আগ্রাসন নেই। কলকাতার বাঙালী হিসাবে ঢাকা এসে ভালোলাগার সর্বোচ্চ জায়গা এটাই। আনন্দময় ঢাকায় তাই বাংলার জয়জয়কার। ভাষার আঞ্চলিক ব্যবহার নিয়ে গভীরে নাই বা ঢুকলাম এখনি। চব্বিশ পরগনা ও বাঁকুড়ার বাংলা যেমন আলাদা, চট্টগ্রাম ও ঢাকার ভাষাও তেমনই আলাদা। কক্সবাজার যাবার সুবাদে পেরিয়ে গেছি অনেকগুলো জেলা ও উপজেলা। তাদের প্রত্যেকের কথা বলার ধরন আলাদা ও স্বতন্ত্র। পেরিয়ে গেছি কুমিল্লা, চট্টগ্রাম। সারারাত বাসে চেপে গেলেও রাতে দাঁড়িয়েছি দুবার। সেও যেন ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা। সূদুর ভারত থেকে অন্য দেশে পৌঁছে সবকিছু যে মসৃণ ভাবে সম্পন্ন হয়েছে তা কি হয়? হয়ওনি। কিন্তু তাও আনন্দে কেটে গেছে নাতিদীর্ঘ আটটি দিন। অনেক মানুষের সাথে মিশে, কথা বলে সেই দেশের সংস্কৃতির সাথে নিজেকে ডোবানোই ছিল উদ্দেশ্য। আর যতটুকু পেরেছি নিজের দেশের সংস্কৃতি ও ভাষাকে তুলে ধরতে চেয়েছি সেই মানুষগুলোর সামনে। দুই দেশের এই ভাবের বিনিময়টাই তো স্বাস্থ্যকর সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। একটা মজার অভিজ্ঞতা শুনবেন? আমরা মিষ্টির দোকানে মিষ্টি কিনি প্রতি পিস দরে। ধরুন রসগোল্লা ১০ টাকা পিস। ইচ্ছে হলে খেয়ে নিই দু একটা কিনে। কিন্তু ঢাকায় ঘুরে বেড়ানোর সময় বহুবার মিষ্টি খেতে ইচ্ছা হওয়ার পরেও কোনো দোকানেই মিষ্টি কিনে খাওয়ার সাহস করে উঠতে পারিনি। কেন শুনবেন? মিষ্টির দাম কেজি দরে। অর্থাৎ আমি একা মানুষ, ঠিক পরিমাণে কত গ্রাম মিষ্টি খাবার জন্য অর্ডার করবো বুঝে উঠতে উঠতেই সাত আটটা দিন কেটে গেছে। হা হা হা হা৷

রাতের উত্তরা

প্রধানত আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবে টাঙ্গাইল জেলার শালিয়াবহ গ্রামে মতিয়ারা মুক্তা (মাটির মা ফাউন্ডেশন) আপুর আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পৌঁছে গেছিলাম বাংলাদেশ। যাওয়ার অভিজ্ঞতা ভীষণ ভালো৷ আগেই একটি পোস্টে সেই অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছিলাম৷ পরিকল্পনা ছিল কয়েকদিন ঢাকা কক্সবাজার ভ্রমণ করে তারপর পৌঁছবো টাঙ্গাইলে। সেইমত আগে থেকে টিকিটও কেটে নিয়েছিলাম সমস্ত বাসের। যতই হোক প্রথম বার যাওয়া৷ তাও আবার এদেশের সিমকার্ডগুলো সব বর্ডার পেরোনোর পর থেকেই অকেজো৷ যা হোক করে কমলাপুর রেল স্টেশনের গ্রামীণ ফোন কাউন্টার থেকে একটা বাংলাদেশী সিম জোগাড় করতে পেরেছিলাম এই রক্ষে। নাহলে আবার কদিনের জন্য ফিরে যেতে হত বিগত শতাব্দীতে। আজকের যুগে স্মার্টফোনে সিম ছাড়া সেটাই তো আমাদের প্রকৃত অবস্থা৷ তাই না? কিন্তু কপাল ভালো, সে অবস্থা আমায় গ্রাস করেনি।

ঢাকায় কবিতা ক্যাফেতে নোঙরের অনুষ্ঠানে সম্মাননা গ্রহণ, বাম পাশে নোঙরের কর্ণধার জনাব হাসানুজ্জামান

কবিতা ক্যাফেতে শহীদ শফিউর রহমান স্মারক বক্তৃতা

ঢাকায় ঘোরার খুব একটা বেশি সময় পাইনি। স্বল্প সময়ের মধ্যে আবার ছিল সাহিত্যচক্রের আমন্ত্রণ। ঈশ্বরদীর নোঙর সংগঠনের কর্ণধার অধ্যাপক জনাব হাসানুজ্জামান আগে থেকেই আমন্ত্রণ করে রেখেছিলেন কাঁটাবন কবিতা ক্যাফেতে তাঁর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগে শফিউর রহমানের ভুমিকা নিয়ে কিছু বলার। সফিউর রহমান ভারতবর্ষে হুগলি জেলার সন্তান। আমার বাসস্থান থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে তাঁর জন্মস্থান। কপালফেরে ঢাকা গিয়ে মিছিলে সেদিন খানসেনার গুলি খেতে হয় ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। তার একদিন পরে মৃত্যু। অমর এগারোজন শহীদের একজন এই মহান ব্যক্তিত্বকে নিয়ে বলার দায়িত্ব পাওয়া ছিল আমার কাছে এক অনন্য সম্মান। তাই ঢাকায় বেশিরভাগ সময়টাই কেটে গেছিল সাহিত্য আর কবিতাকে কেন্দ্র করে। বাকি সময়টুকু ছুটে বেড়িয়েছিলাম শহরটার এপার থেকে ওপার। চড়েছিলাম নবনির্মিত মেট্রোতেও। এমনকি চড়েছি বিখ্যাত রিক্সাতেও৷ কিন্তু কখনোই মুক্তি পাইনি জানজটের হাত থেকে।

ঢাকা বইমেলায় কিছুক্ষণ। সঙ্গে বাংলাদেশের কবি ও সাহিত্যিকরা

ঢাকায় শহীদ মিনারে গিয়ে একবার দাঁড়ানো আমার কাছে ছিল স্বপ্নের মত। আর সেই স্বপ্ন যখন পূরণ হল, তখন নিজেই নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখলাম আমি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে। মনে মনে অমর এগারো সৈনিককে প্রণাম জানিয়ে এগিয়ে গেলাম একবার মিনারটিকে স্পর্শ করতে। খালি পায়ে মিনার স্পর্শ করে যখন দাঁড়ালাম তখন স্বপ্নেরা একে একে এসে স্পর্শ করছে আমার পার্থিব শরীর। আর চোখের সামনে ফুটে উঠছে বরকত, শফিউরদের অমর লড়াই। আমার শহর ভ্রমণের সঙ্গী ছিল ঢাকার বিখ্যাত মানবাধিকার কর্মী জাকিয়া শিশির আপু এবং কবি উম্মে হাবিবা মায়া। এরা দুজনেই আজ আমার আপনজন। সম্পর্ক কখনো দেশের লাগাম মানে না। তার কোন সীমা নেই, তার কোন বাধা নেই। সবটাই যেন অসীমের মাঝে সীমাহীন ভালোবাসার মত। ঢাকার দিনগুলো যত্ন করে এঁরাই আমাকে সঙ্গ দিয়ে গেছেন নিয়ম করে। সে ঢাকা একুশে বইমেলা হোক, অথবা শহীদ মিনার বা ধানমন্ডি। নোঙরে হাসান ভাইয়ের অনুষ্ঠানের পরেই আমরা কয়েকঘন্টার জন্য বেরিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও বইমেলা ঘুরে দেখতে। একটি সি এন জি অটো বুক করে চটজলদি ঘুরে দেখেছি অনেকগুলো জায়গা। তারপর বইমেলায় ঢুকে চেনাপরিচিত সাহিত্যিকদের সাথে বসেছি জমিয়ে আড্ডায়৷ ভারত থেকে গেছি বলে যে আতিথেয়তা আমি পেয়েছি, তা কখনো ভোলার নয়৷ প্রচুর মানুষ ছুটে এসেছেন শুধু একটা ছবি তোলার জন্য বা আমার একটি বই সংগ্রহ করবার জন্য৷ এই ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবার ক্ষমতাও আমার নেই৷ তাই সবটা বুকে নিয়েই প্রতিনিয়ত হেঁটে বেড়াই কলকাতার মাটিতে। দুই দেশের সীমান্ত তো শুধুই একটি রাজনৈতিক বেড়াজাল৷ মনের কোনো সীমানা হয় নাকি৷ মনের সীমানা খুঁজে বেড়ানোর তাড়নায় নিজের কাছে অস্তিত্বকেই যাঁরা হারিয়ে ফেলেন, তাঁদের আর একটু আলো তো অবশ্যই প্রয়োজন।

"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। আমি কি ভুলিতে পারি?"

---

চিত্রগ্রহণ	ইনফিনিক্স হট ৩০
ক্যামেরা	৫০ মেগাপিক্সেল