ফেসবুক ও উত্তর আধুনিক সাহিত্যচর্চা। একটি বিশ্লেষণ।
ফেসবুক ও উত্তর আধুনিক সাহিত্যচর্চা
জীবনানন্দ বলেছিলেন 'সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি'। কবির সংজ্ঞা নিয়ে যুগে যুগেই আমরা উঁকিঝুঁকি দিয়েছি সাহিত্য সমালোচকের কলমে কলমে। মাথাচাড়া দিয়েছে বহু তর্ক। তবু প্রশ্ন একটাই, কারা কবি? আর কারা কবি নন? কবি অর্থে কাব্যের মূল চালক নাকি শুধুমাত্র কাব্যের সৃষ্টিশীলতার ও নান্দনিকতার প্রথম পুরোধা তা নিয়ে আবহমান কাল থেকেই ভিন্নমত রয়েই গেছে। তবে এমন বাঙালী খুঁজে পাওয়া দায় যিনি লাল গোলাপ হাতে ভাবী প্রেয়সীর বেশ খানিকটা বিপজ্জনক দূরত্বের মধ্যে এসে দুলাইন অন্ত্যমিল আওড়ায় নি। অথবা স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে দেশ নিয়ে বেশ রক্ত গরম করা চারটি পংক্তি পোস্ট করেন নি। এই দেখুন। জরুরি ভিত্তিতে একটা প্রশ্ন উঠেই এলো। 'পোস্ট'। লেখা ছাপা আর পোস্টের মধ্যে কি সত্যিই বিন্দুমাত্র ফারাক পর্যন্ত নেই? আমরা কবি খুঁজবো নাকি কাব্য? বলাই বাহুল্য আমরা উভয়ই খুঁজি। কবিহীন সমাজ কিভাবে এক ভয়াবহ স্থিতাবস্থার অভাব চিহ্নিত করে দেয় সেটা কি আর শিক্ষিত পাঠকসমাজকে বলে দিতে হয়? যে সংকল্প বুকে নিয়ে প্রায় ৬০ বছর আগে মলয় রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী বা দেবী রায়রা পাটনায় হাংরি ইস্তেহার প্রকাশ করেছিলেন তা সফল ছিল কিনা তা নিয়ে বিস্তর লড়াই যেমন চলছে তেমনই চলুক। কিন্তু এই ফেসবুকীয় সাহিত্য আন্দোলন যে পুরোমাত্রায় সফল তা আনাচেকানাচে কান পাতলেই শুনতে পাওয়া যাবে। আপনাকে গ্যাঁটের কড়ি খসিয়ে আগামীকে কিছুমাত্র গবেষণা করতে হবে না। সেই গবেষণার স্পর্ধা যে আপনার হবেও না তা বিলক্ষণ জানা। কারণ ঝড়ের আবহে কোন্ খড়কুটোই বা নিজের স্থানে অবিচল থাকতে পেরেছে? না, যথারীতিই পারেনি। ফেসবুক ঠিক তেমনই এক বিন্ধ্যাচল। যে বর্তমান সাহিত্য চর্চাকে আক্ষরিকভাবেই মাথায় করে রেখেছে। কিন্তু এই মাথায় তোলার আগে যোগ্যতা নির্ধারণের পরীক্ষাটি কি অত্যাবশ্যক নয়? তবে কি আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আমরা মেনে নেব যে পত্রিকার সম্পাদকরা ভূমিকাহীন ছিলেন? দীর্ঘদিনের সাহিত্যচর্চায় সম্পাদনার গুরুত্ব বারেবারে নতুন নতুন সংজ্ঞায় উঠে আসতে দেখেছি কিংবদন্তি লেখকদের কলমে। তাহলে সম্পাদনা বিষয়টির একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা আশু প্রয়োজন। নিরপেক্ষ ও ব্যক্তিসত্তার উপরে উঠে সাহিত্যগুণ বিচার করা সম্পাদকের একটি প্রধান গুণ। ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ থেকে সুনীলের কৃত্তিবাস - সময়ের প্রতিটি পর্যায়ে আমরা দেখে এসেছি সাহিত্য বহমানতারই এক অবিচ্ছিন্ন ধারাকে। আমরা কাগজের পাতা খুলেই পড়তে শিখেছি সম্পাদকীয় কলম। কিন্তু ফেসবুকীয় সাহিত্যপাতা সম্পাদকহীন। তার সেই সৃষ্টিছাড়া শ্রীমন্ডপে সকলেই আপন আপন সম্পাদনাকার্যে নিপুণ। প্রয়োজন নেই সম্পাদক, প্রয়োজন নেই প্রকাশক অথবা পৃষ্ঠপোষকতারও। গঙ্গার জলের গতিতে প্রতিটি ঢেউ আছড়ে পড়ছে দুইপাড়ে। বোঝার উপায় বড় কম যে ঢেউটি জোয়ারের না ভাঁটার। বলাই বাহুল্য, এর ভালো মন্দ দুই দিকই বিদ্যমান।
প্রসঙ্গত বলি ব্রাহ্মধর্মের নেতা ও তত্ত্ববোধিনী সভার প্রতিষ্ঠাতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার জন্য সম্পাদক নিয়োগ করেছিলেন অক্ষয়কুমার দত্তকে। কিন্তু পরে মালিকের সঙ্গে সম্পাদকের গড়ে ওঠে বিরোধ। মালিক ব্রাহ্ম উপাসক হলেও সম্পাদক সমাজসংস্কারপন্থী। তবু মননের ফারাক সত্ত্বেও দেবেন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমারকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন পত্রিকা পরিচালনায়। সম্পাদকের চিরাচরিত ভূমিকা ও কাব্যবাছাই এর নির্বিকল্প ক্ষমতা কি তবে অপ্রাসঙ্গিক ছিল? না না, আমি বলছিনা। সে ধৃষ্টতা অন্তত আমার নেই। কিন্তু ফেসবুকীয় সাহিত্য কি এই মর্মে সাক্ষ্য দিচ্ছে না?
আজ মনে পড়ে, লেখকজীবনের প্রথম ভাগে কবিতা পাঠানোর অব্যবহিত পরে জনৈক লিটিল ম্যাগাজিন দপ্তর থেকে চিঠি এলো। 'আপনার কবিতায় ছন্দে ভুল আছে। তাই ছাপা হল না। দয়া করে অন্য একটি স্বনির্বাচিত কবিতা পাঠান।'
কি এই ছন্দ? কি তার মাত্রা? দল, পর্ব, যতি? এইসব ছিদ্র পূরণে যখন কবি ও সম্পাদকদের দ্বারস্থ হচ্ছি প্রায় রোজ রোজ, তখনই কেউ যেন গাড়িটা চালাতে বলে স্টিয়ারিং দিয়ে দিল হাতে। ব্যাস। রাস্তা বাঁয়ে ঘুরলে আমায় যে স্টিয়ারিং বাঁয়েই ঘোরাতে হবে। তখন কি আর ব্যকরণ ভিন্ন গাড়ি পরিচালনার স্বাধীনতার অত্যুক্তি আসে? স্বভাবতই না। শোনা যায় বার্নাড শ' কেও নাকি পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকের দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়েছিল। জে কে রাউলিংকে হ্যারি পটারের পাণ্ডুলিপি দেখার পরও আটজন প্রকাশক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ফেসবুক সাহিত্যে এই প্রত্যাখ্যান পুরোপুরি বিবর্জিত। সম্পাদনার লেশমাত্র নেই। নেই লেখা নির্বাচনের ঝক্কি। সাহিত্যমান বিচার থেকে কবিতা বা গদ্যের কিছুমাত্র ভুল সংশোধন - এসব তো অনেক দূরের বিষয়। কমেন্টের মাধ্যমে সামান্য সমালোচিত হলেই কবি বা লেখক রে রে করে তেড়ে আসছেন মন্তব্যকারীর দিকে। যেন এক অস্তিত্ব রক্ষার তীব্র তাগিদ। নিজের হয়েই নিজের লড়াই। বাংলা সাহিত্যের আবহমানতার হাত ধরে কোথাও এই জ্ঞানের সংকীর্ণতা সাহিত্যের দেউলিয়াপনার ইঙ্গিত নয় তো? প্রশ্নটা কিন্তু রয়েই গেল। সত্যিই কি তবে ফেসবুকীয় সাহিত্যের জগতে আমরা নিজেদের হারিয়ে ফেলছি নিজস্বতার আপোষেই?
সর্বোপরি আমরা কি কোনো কলমকেই আদ্যোপান্ত কবিতা হয়ে উঠতে দেখছি না? অবশ্যই দেখছি। এবং এও অনস্বীকার্য যে এযাবৎ ফেসবুক জন্ম দিয়েছে বহু কবির, যাদের কবিতা আজ বাংলার বহু পত্রপত্রিকাতেও প্রকাশিত ও বহুল পঠিত। এঁরা আজ পাঠকমধ্যে বহু পরিচিতও। উত্তর আধুনিক এই যুগে বই বিক্রির থেকে পাঠক যে ডিজিটাল ও ওয়েব প্লাটফর্ম গুলোতেই চোখ বেশি রাখেন তা এককথায় মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু প্রকৃত সাহিত্য অর্থেই তো সমালোচনার আঁতুড়ঘর। প্রবাসীতে ১৩১৩ বঙ্গাব্দে ‘কাব্যের অভিব্যক্তি’ প্রবন্ধে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখছেন, ‘ বঙ্গের অস্পষ্ট কবিগণ বড়োই অধিক শেলি, ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও ব্রাউনিং এর দোহাই দেন। এই ইংরাজ কবিগণ স্থানে স্থানে দুর্বোধ্য বটে। কিন্তু তাঁহাদের কাব্যের মূল বা কেন্দ্রস্থ ভাব ধরিতে কষ্ট হয় না। কিন্তু আমাদের বঙ্গীয় কবিগণের কাব্যের কোনও ভাবই ধরা যায় না। আমাদের দেশের এই অস্পষ্ট কবিদের অগ্রণী শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ কবি ও কাব্যের সমালোচনায় এর বেশি কি আর কিছু বোঝানো বাকি থেকে যায়? কিন্তু আজকের আবহ কি এই সহনশীলতাকে মেনে নেয়?
আজ বহু কবি, বহু সমালোচক আর বহু কাব্যরসিক। কিন্তু কবিতা? তা সেই 'কেউ কেউ কবি' তত্ত্বের গোড়াতেই জল, রোদ ও সারহীন অবস্থায় অপরিণত অঙ্কুর হয়েই রয়ে গেল না তো? প্রশ্নটার উত্তর হয়ত আগামীই দেবে। আমরাও অপেক্ষায় রইলাম।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
https://x.com/KausikChak1234/status/1892066269198709111?t=HQoTNzDptto55wYQXsehow&s=19
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Daily tasks-