স্মৃতির সরণি বেয়ে ফিরে যাওয়া কিছু হারানো দিনের খোঁজে

in আমার বাংলা ব্লগ4 days ago (edited)

স্মৃতির সরণি বেয়ে


🪷🪷🪷🪷🪷🪷🪷🪷🪷🪷🪷🪷🪷


AddText_06-29-11.32.56.jpg

💮আসুন সামিল হই স্মৃতির খোঁজে💮

আজ আমার জীবনের একটা সময় আপনাদের সাথে শেয়ার করব৷ সব অভিজ্ঞতাই জীবনে কিছু না কিছু শেখায়৷ আমিও এই দীর্ঘ চলার পথে অনেক কিছু শিখেছি৷ দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতা পেশার সাথে যুক্ত৷ ফলে বহু অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকতে হয়েছে। আজ সেরকমই কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করব আপনাদের কাছে৷ স্কুল জীবনের দিনগুলো যেন কোথায় হারিয়ে যায়। কলকাতা শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে স্কুল কলেজে জীবন কেটেছে আমার৷ শহরতলীর ছেলে হলেও কলেজ স্ট্রিট চত্ত্বরে পড়ার কারণে শহরের আদপকায়দার বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম অনেক আগে থেকেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় আমি বিশ্বাসী নই কোনোদিনই। কিন্তু তবু বিশ্বাস করি, প্রতিষ্ঠান মানুষের মূল্যবোধ আর জীবন দর্শনের সুক্ষ্ম দিকগুলো তৈরি করে দেয়। আমি যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়েছি তার সবকটিই প্রায় বাংলার ইতিহাসের এক একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। স্কুলে পড়তে পড়তে জড়িয়ে গেছিলাম লিটিল ম্যাগাজিনের সাথে। সেটাই জীবনে প্রথম ম্যাগাজিন আন্দোলনে হাতেখড়ি। তারপর সেই পত্রিকা নিয়ে কত টানাপোড়েন, ওঠাপড়া। স্কুল জীবনটা যেন এক অদ্ভুত অধ্যায়। কত তার রং। প্রতিদিন নতুন নতুন রঙে নিজেকে মুড়ে রাখা।

1719684783211.jpg

আমাদের স্কুল পত্রিকা

বয়স বাড়ার সাথে সাথে সমাজ, সংসারের দায়িত্ব ও ওজন নুইয়ে দেয় ঘাড়। ফেলে আসা দিন পিছনেই পড়ে থাকে। অনেক চাইলেও সেই দিনগুলো আর সাড়া দেয় না। শুধু স্মৃতির কোণে সাজানো থাকে সেই দিনগুলোর ঘটনা প্রবাহ। কলেজ স্ট্রিটে সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করাকালীন মনে পড়ে স্কুলের ১৭৫ তম জন্ম বার্ষিকী উদযাপনের কথা। সে এক বিশাল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন হয়েছিল স্কুলের ১৭৫ বছর। স্কুল প্রতিষ্ঠা ১৮২৪ সালে। ১৯৯৯ সালে স্কুলে পালিত হয়েছিল এই উৎসব। প্রস্তুতি ছিল তার আগে প্রায় আরো একটি বছর ধরে। আমি তখন স্কুলের ছাত্র। ফলত জুড়ে গেছিলাম অনুষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবক কমিটির মধ্যে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন স্বয়ং বাংলার রাজ্যপাল। উদ্বোধন হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি। সংস্কৃত কলেজের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের যোগাযোগ আপনারা সকলেই জানেন। এক সময় তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে আসীন ছিলেন। আমাদের স্কুল সেই গরিমা ও গৌরবের দিনকে স্মরণ করে বিদ্যাসাগরের মূর্তি উন্মোচন করে। আজও সেই মূর্তি স্কুলের মেইন গেটের পাশে বিদ্যমান। সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলের পর আমি একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম হিন্দু স্কুলে। বাংলার ইতিহাসে সেও এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের নাম। স্কুলে প্রধান ফটক দিয়ে ঢোকার পরেই প্রথম দিন চোখে পড়েছিল একাধিক বিশিষ্ট ছাত্রদের নাম। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু কে নেই সেখানে। আজও স্কুলের সিঁড়িটির দিকে তাকালে কোথায় যেন আটকে যায় মন। মনে হয় ছুটে যাই সেই দোতলার বারান্দায়, যেখানে জীবন বাবু শাস্তি দিলে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেছি আকাশের পাখি দেখতে দেখতে।

FB_IMG_1719684339168.jpg

হিন্দু স্কুলের মেন গেট। কত স্মৃতি এই জায়গায়

স্কুলে পড়াকালীন সরস্বতী পুজোর কথা খুব মনে পড়ছে। সে এক আলাদা রকমই অভিজ্ঞতা ছিল জানেন। পুজোর একমাস আগে থেকে শুরু হত তোড়জোড়। কুমোরটুলিতে গিয়ে ঠাকুর বুকিং করা, পুজোর দিন সবরকম ইভেন্টের আয়োজন। আর সব থেকে আকর্ষণীয় ও মজাদার বিষয়টি ছিল আশপাশের মেয়েদের স্কুলে নিমন্ত্রণ করতে যাওয়া। এটির জন্য রীতিমতো ছেলেদের লাইন পড়তো। আর স্যারেরা সবাইকে ছেঁটে বেশ ভদ্র, সাদাসিধে, মেধাবী কোনো ছেলেকে বেছে নিতেন। বাকিদের মুখ ব্যাজার। পুজোর দিনও সকাল থেকেই ব্যস্ততা তুঙ্গে। স্কুলের সব ছাত্রদের ওইদিন খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হত না। পরে কোন একটা দিন বেছে নিয়ে করা হত খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। পুজোর দিন থাকতো বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিভিন্ন ক্লাসের ছেলেরা গান, নাটক বা আবৃত্তির মাধ্যমে তাদের প্রতিভা তুলে ধরত সকলের সামনে। এরপর একটি প্রতীক্ষিত বিষয় ছিল ক্লাস সাজানো। এর উপর ভিত্তি করে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় পুরস্কারও প্রদান করা হতো স্কুলের তরফে। আর সেই নিয়ে হত তীব্র প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা এলে তাদেরকেও পুজোর বিবরণী ও ছবি তোলায় সাহায্য করতো স্কুলের ছেলেরাই।

এমন ভাবেই সুখে দুঃখে আনন্দ করে স্কুলের দিনগুলো কেটে গেছে। আজ জীবন অন্যরকম। কর্মজীবনের চাপ এবং দায়িত্ববোধ এসে পড়েছে মাথার ওপর। সার্থক আমাদের চতুরাশ্রম। কিন্তু এই চারটি আশ্রম এর মধ্যে শিক্ষালাভের স্তরটি সবার উপরে। আর এই সময়েই জীবনের যে মূল্যবোধ তৈরি হয় তা আজীবন টেনে নিয়ে যায় মানুষের জীবনের প্রতিটি ধাপকে। আজ প্রতিদিন মনে হয় স্মৃতির স্মরণে বেয়ে ছুটে যাই সেই সব দিনগুলাই। যেখানে অনাবিল জীবনের আনন্দ ভরে থাকতো কানায় কানায়। মাস্টারমশাইদের শাসন এবং স্নেহভরা ব্যবহার সহজ করে দিত পরিস্থিতিগুলোকে। এইজন্যই হয়ত বলে স্মৃতি সততই সুখের। সেই সময়ের অতি সাধারণ দিনগুলোও আজ কেমন অসাধারণ উচ্চতায় মাথার মধ্যে কিলবিল করে। আজও ইচ্ছে করে যদি কেউ হাত ধরে একবার টেনে নিয়ে যায় হেড মাস্টারমশাইয়ের ঘরে, বা ছুটে গিয়ে একবার আমার বিরুদ্ধে নালিশ করে ক্লাস টিচারের কাছে, আর ছুটির আগে থেকেই যদি মা এসে অপেক্ষা করেন স্কুলের গেটে, তবে সবকিছুই কেমন বদলে যেত তাই না? কিন্তু দুর্ভাগ্য, পিছনে যাওয়ার উপায় কই? আমাদের যে সামনে হেঁটে চলতে হয়। আর তারই নাম জীবন।

images__27_-removebg-preview.png


--লেখক পরিচিতি--

IMG_20240303_181107_644.jpg

কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার সহ সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।


Sort:  
 3 days ago 

দাদা একদম ঠিক বলেছো স্মৃতি সততই সুখের। সেই সোনালি সময়ের অতি সাধারণ দিনগুলো মনের মনিকোঠায় আজ কেমন অসাধারণ উচ্চতায় মাথার মধ্যে কিলবিল করে।
সেই স্কুল জীবন সেই কলেজ জীবন গুলো। তোমার মত করে আমার আজও ইচ্ছে করে যদি কেউ হাত হাত ধরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারত সেই অতীত স্মৃতিময় দিনগুলিতে। আসলেই এই ভাবনাগুলো এক ধরনের পাগলামি।

যাইহোক এত সুন্দর ভাবে গুছিয়ে লিখলে, পুরো লেখাটা মনোযোগ সহকারে পড়ে আমিও অতিতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। আর মনে পড়ে গেল তোমার পোস্টের টাইটেল টা -----

স্মৃতির সরণি বেয়ে ফিরে যাওয়া কিছু হারানো দিনের খোঁজে।

 3 days ago 

ভীষণ অনুপ্রাণিত হলাম তোমার মন্তব্যে। তোমারও স্কুল জীবন নিয়ে তুমি লিখে ফেলো একদিন। এই হারানো অতীতগুলো যেন তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যায় ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সত্যিই এ যেন এক পাগলামি। আর আমাদের মত পাগলদের এইসব পাগলামিই যেন পথ হাঁটার একমাত্র প্রশ্রয়।

Coin Marketplace

STEEM 0.19
TRX 0.13
JST 0.030
BTC 60295.64
ETH 3298.00
USDT 1.00
SBD 2.37