।।আমার কবিতা যাপনের মুহূর্ত।।
আমার জীবনে কবিতা ও সাহিত্যসভা
আজ একটু অন্য কথা বলি। একটা কথা খুব মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তা হল কবিতা কেন লিখি? কী পাই? লোকে বলে 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ' তাড়িয়ে এসব করে লাভ কী? আমি উত্তর খুঁজি আকাশ পাতাল। এ যেন এক আশ্চর্য চক্রাবর্ত। অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকলে আলো চায় মন। আবার আলোর দিশা পেলে হাতছানি দেয় অন্ধকার। সংস্কৃত শ্লোকে ছেলেবেলাতেই পড়েছি -
সুখমাপতিতং সেব্যং দুঃখমাপতিতং তথা,
চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি চ
এই উক্তির আত্মস্থকরণ তখনই সম্ভব, যদি কেউ আগামীর আলো দেখতে পারে। এই আগামীর আলো কী? অর্থ? মান? যশ? খ্যাতি? প্রতিপত্তি? শিক্ষা? সম্মান? সুখ? আসলেই এসবের সংজ্ঞা বড় আপেক্ষিক৷ অন্ধকার ভালোবেসেই জলের কোন অতলে তলিয়ে যায় মাছ। আবার সামান্য আলোর খোঁজে উঠে আসে জলতলে। এই চক্রাবর্ত মানুষের জীবনকে স্থির হতে দেয় কি? কখনোই না।
আমার কাছে কবিতা এক জন্মান্তরবাদ। জন্মান্তর কী? আসুন একটু পাশাপাশি বসা যাক৷ দৈনিক পথ চলায় হাঁপিয়ে উঠতে উঠতে যখন আপনার একটু সূর্যদয় দেখতে ইচ্ছে হবে, তখন আপনাকে এসে দাঁড়াতেই হবে খোলা বারান্দার একটা ফাঁকা কোণে। জীবনের চক্রাবর্তে ঘটে যাওয়া অসংখ্য চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যখন আপনি একলা সেই কার্নিশে এসে দাঁড়াবেন, তখন নবজন্ম অপেক্ষা করবে আপনার সামনে। আর আমার কাছে কবিতাই হল সেই উপান্তের ডাক। যেখানে দাঁড়ালে বয়ে যায় শীতল হাওয়া৷ দক্ষিণ দিক থেকে উড়ে আসে নরম মেঘ। আর কখনও কখনও ভিজিয়ে দিয়ে যায় নিজস্বতায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন -
কবিতার বিশেষত্ব হচ্ছে তার গতিশীলতা,এই গতির শেষ নেই।
এই অনন্ত ছুটে চলার যে সুখ, তা বেঁধে রাখবার নয়। প্রতিদিন তাই একটু করে কবিতার পংক্তি না জন্ম নিলে নিজেকেই কেমন যেন অস্থিরতায় পায়৷ যেন গলা টিপে দিতে আসে অসংখ্য নির্মমতা। পৃথিবীতে নিষ্ঠুরতার তো অভাব নেই। দিকে দিকে সেই পাশবিক চিৎকার ফালা ফালা করে দিচ্ছে দিগন্তকে। আর এরমধ্যেই দরকার বেঁচে থাকবার অনুঘটক। যে মানুষের কেউ নেই, তার আকাশ আছে৷ যে মানুষের কেউ নেই তার নদী আছে৷ ঠিক তেমনই আমার বা আমাদের মত কবিতাপ্রেমীদের কাছে কবিতা হল জিওনকাঠি। সব সংলাপ নিজের কোঠরে সযত্নে তুলে রাখবার নিরাপদ সিন্দুক।
ধরুন প্রিয় মানুষের সাথে দেখা হওয়ার পরে দীর্ঘ বিরতি। তার সাথে কাটানো মুহূর্ত কুরে কুরে খাচ্ছে অহরহ৷ একটি কবিতা যেন সেখানেও নিশ্চিন্ত নিরাময়৷ দুহাত ধরে মনটাকে একান্তে নিবিড় করে তোলে ক্ষণিকেই। খুব কাছ থেকে কেউ বলে, কবিতাই আশ্রয়। এসো। খানিক বসে যাও পাশে।
কবিতার উৎপত্তি আজ নয়। দুই মৈথুনক্রিয়ায় লিপ্ত বকের অকালমৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল মহাকবি বাল্মিকীকে। তাঁর কণ্ঠ থেকে প্রথম নির্গত হয়েছিল শ্লোক৷ আর তা বাঁধা হয় অনুষ্টুপ ছন্দের বাঁধনে৷ তিনি বলে ওঠেন -
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।যৎক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্
বাল্মিকীর শোক থেকে উৎপন্ন বলে এর নাম হয় শ্লোক। আর এই অনুষ্টুপ ছন্দের শ্লোকেই বাঁধা রামায়ণ ও মহাভারতের মত আদিকাব্য। তাই কবিতা বা ছন্দের উৎপত্তি সাহিত্যের আদিরসকে স্পর্শ করে সহজেই৷ কোথায় তখন গদ্য? কোথায় নাটক, গল্প, উপন্যাস? কবিদের মননের ভাষাই ছিল পদ্য বা কবিতা। সেই সূত্রে বলতে গেলে বিদ্যাপতি থেকে চণ্ডীদাস, সকলেই বাংলা পদ্যধারার প্রথমদিকের ধারক ও বাহক৷ রবীন্দ্রনাথও তীব্রভাবে প্রভাবিত ছিলেন বিদ্যাপতিতে। মাত্র ২৩ বছর বয়সে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী তাঁর বৈষ্ণব ভাবধারা ও বিদ্যাপতির প্রভাবের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাই রবীন্দ্রনাথ ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, সুরকার হলেও সবার আগে তিনি বিশ্বকবি। আর এই কবিসত্ত্বার পিছনেই কবি ছুটে বেড়িয়েছেন আজীবন। জীবনের শেষ দিকে পৌঁছে বাবা মশাই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কেনা জমিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন ভিন্নমতাদর্শের ভিত্তিতে তৈরি গড়ে ওঠা এক বিশ্ববিদ্যালয় - শান্তিনিকেতন। তাই আমাদের পরম বাউল রবীন্দ্রনাথের জীবনটাই তো আদ্যোপান্ত এক কবিতা।
এই কবিতার পিছনেই যেন আমার অনন্ত ছুটে চলা। অর্থ, যশ, খ্যাতির ঊর্ধে উঠে শুধু কবিতার পংক্তিতে বিচরণ যেন বরাবরই পরম আনন্দে মিশিয়ে দিয়েছে আমার অনাবিল চিত্তটুকু। কবিতাই যেন চার দেয়ালের মধ্যে এক জীবন্ত চিলেকোঠা, আবার খোলা আকাশের নিচে এক পশলা বৃষ্টি। আর এই যাপনটুকু নিয়েই হেঁটে চলেছি দীর্ঘ সময়। হাত ধরে পথ দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে আজকের যুগের অসংখ্য অগ্রজ কবিরা। একদম কাছ থেকে সান্নিধ্য পেয়েছি কবি সুবোধ সরকার, কবি মৃণাল বসুচৌধুরী, কবি হাসমত জালাল, কবি রেহান কৌশিকের মত ব্যক্তিত্বদের। তাঁদের সাহচর্যে কেটে গেছে অগুনতি মূল্যবান সব সময়। যা অর্থের মানদণ্ডেও পরিমাণ করা অসম্ভব। তাই বিশ্বাস করি, হয়ত মানুষ দিনের শেষে চাল ডাল কিনতে পারে, কিন্তু কবিতা কিনতে পারে না। কবিতা এক বোধের অন্দরমহল, যা খোলসত্যাগ করতে শেখায়।
সপ্তাহের শেষে একটি কবিতা সভার আহ্বান যেন অনায়াসে বপন করে দেয় একাধিক নির্ভcenterজ৷ এই নির্ভরতার কোন পিছুটান নেই। কয়েকটা পরিশ্রান্ত দিনের পরে বসে কয়েকটি কবিতা শোনা এবং নিজে একটি কবিতা পাঠ করা যে পরম আনন্দ দেয়, এবং সারা সপ্তাহের যন্ত্রণা, ক্লান্তি, গ্লানি যেভাবে নিমেষে দূর করে, তা এক কথায় অবর্ণনীয়। কখনো উত্তর কলকাতায় কবিতা পাঠ করতে গেছি সিমলা স্ট্রিটে বিবেকানন্দের বাড়ি, আবার কখনো কবিতার ডাকে পৌঁছে গেছি স্বাধীনতার ইতিহাস বিখ্যাত ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভাঘরে। এভাবেই কবিতার জন্য ছুটে বেড়াই সারা বাংলা জুড়ে। কখনো ভারত কখনো বাংলাদেশ। কিন্তু কবিতার কোন বেড়াজাল নেই। কবিতার কোনো দাবীও নেই৷ বরং কবিতার প্রতিই আমাদের অনেক দাবী৷ সব অন্ধকার মুছে গেলে যে আলোর রোশনাইতে ঝলসে যায় চোখ, তার একপ্রান্তেই ঝলমল করে কবিতার এক একটি রুপোলী পংক্তি৷ আর সেইটুকু মেখে নিলেই যেন পরম তৃপ্তি।
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার সহ সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
যথার্থ।
ধন্যবাদ ভাই৷ সত্যিই এ এক পরম সত্য৷ কবিতার কোনো বিনিময় মূল্য হয় না৷ আর তার কোনো এককও হয় না৷ এ যেন কেবলই বোধের নির্মাণশিল্প
সাহিত্য এবং কবিতার টানে আজ তোমার সাথে আমার পরিচয়। দুই বাংলার মিলন মেলায়। আজ কবিতা এবং সাহিত্য তোমাকে যথার্থ প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসেছে। তৈরি হয়েছে বন্ধুত্বের অটুট বন্ধন। এবং আমি বিশ্বাস করি এই কবিতা এবং সাহিত্য তোমাকে অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে যাবে। অন্তহীন শুভকামনা তোমার জন্য। 💕
তোমার সহযোগিতা না থাকলে এখানে লেখার কোন সাধ্যই ছিল না আমার। কবিতা ও কাব্য প্রতিভার যেটুকু এখানে তুলে আনতে পাচ্ছি তার সবটুকু কৃতিত্বই তোমার পাওনা। আমার তরফ থেকেও অন্তহীন শুভেচ্ছা রইল তোমার জন্য।
পোস্ট দেখে বইমেলার স্মৃতি মনে পড়ে গেল৷ কবিতা যাপন নিয়ে বেশ গুছিয়ে লিখেছ। কবিতার আলোয় পথ দেখা যায় যাদের তারাই জানে কবিতার বাঁক কবিতার জীবন।
তোমার এই লেখাটাই একটা টানটান মুক্তগদ্য হয়ে গেছে৷
ভালো লাগল।
হ্যাঁ৷ বইমেলায় কত স্মৃতি। সব গুছিয়ে রেখে দিই মনের কোণে৷ আবার অপেক্ষা করি এক বছর৷ আর সারা বছর ধরে সেই অঙ্কুরিত চারায় জল দেয় অসংখ্য কবিতা৷