কলকাতার বুকে এক অজানা ও হারানো রেলপথ। ইতিহাসের গল্প।
কলকাতার বুকে এক হারানো রেলপথ
জানেন একসময় ম্যাকলয়েড সাহেবের রেলগাড়ি চড়ে কালীঘাট মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়া যেত কলকাতায়? সেকি, অবাক হলেন নাকি। ভাবছেন আজ কোথায় গেল সেই রেল? আর কোথায় উধাও হয়ে গেল আস্ত রেলের লাইন খানা? দাঁড়ান বলি তবে। শহরে আসবার পরে শুধু কোম্পানি বাহাদুরই নয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এ শহরকে ঢেলে সাজাতে চেয়েছে সাহেবরা। লন্ডনের ম্যাকলয়েড রাসেল অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড তার মধ্যে অগ্রগণ্য। কলকাতার কালীঘাট থেকে বেহালা, ঠাকুরপুকুর হয়ে ফলতা পর্যন্ত রেলপথে যুক্ত করেছিল তারা। এছাড়াও বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে রেল চালাতো ম্যাকলয়েড কোম্পানি। আর মানুষ তাকে ডাকতো ম্যাকলয়েড সাহেবের গাড়ি বলে। ইংরেজদের কাছে ফলতার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এদেশে আসার পরে সেই গুছিয়ে বসবার দিনগুলোয় একটু একটু করে যখন তৈরি হচ্ছিল শহর কলকাতা, তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ধেয়ে এসেছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলা। আর বিধ্বস্ত ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ থেকে পালানোর পর এই ফলতাই আশ্রয় দিয়েছিল তাদের। শোনা যায় স্বয়ং ওয়ারেন হেস্টিংসও নাকি সেই স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে মশার কামড়ে কাটিয়েছিলেন কয়েকটি দিন (যদিও সিরাজের কলকাতা আক্রমণকালে তিনি কাশিমবাজারে ছিলেন)। তাই দীর্ঘদিন পরে হলেও রেলপথে কলকাতা থেকে ফলতাকে যুক্ত করবার প্রস্তাব আর ফেলে রাখেনি ইংরেজ বাহাদুর।
ম্যাকলয়েড কোম্পানির সহায়তায় রেলপথে জুড়ে দেন দুই প্রান্ত। একসময়ের ধ্যারধেরে গোবিন্দপুরে জঙ্গলে ঘেরা কালীঘাট মন্দির হয়ে ওঠে বাঙালির প্রিয় গন্তব্য। মা কালী হয়ে ওঠেন আপামর বাঙালির। ফলতা, আমতলা, ঠাকুরপুকুর থেকে তীর্থযাত্রীরা সে কালে ছোট লাইনের রেলে চড়ে দলে দলে পুজো দিতে আসতো কালীঘাটে। আদিগঙ্গার পাড় ঘেঁষে সাহেবের রেল তীর্থ করাতো বাঙালিকে। ১৯১৭ সালের ২৮শে মে তৈরি হয় প্রায় ২৭ মাইল এই রেলপথ। মিশরে ইজিপ্টিয়ান ডেল্টা রেলওয়ের অর্ডারে ইংল্যান্ডে বহু রেল কামড়া তৈরি হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বাজারে সবকটি কামড়া মিশরে পাঠানো যায় নি। আর তখনই ম্যাকলয়েড কোম্পানি সেই উদ্বৃত্ত কামড়াগুলো কিনে তা পাঠিয়ে দেয় কলকাতায়। আর সেইসব কামড়া ইঞ্জিনের সাথে জুড়েই তৈরি হয় ম্যাকলয়েড রেল। এর সাথে সাথেই ন্যারোগেজ লাইনে জুড়ে যায় বাংলার আহমেদপুর - কাটোয়া, বর্ধমান - কাটোয়া আর বাঁকুড়া - দামোদর।
কিন্তু স্বাধীনতার ১০ বছর পরে আদিগঙ্গার পাড়ে এই রেলট্র্যাক বাতিল ঘোষনা করে রেল কোম্পানি। আজ আর ট্রেনে চেপে যাওয়া যায় না ফলতা। ডায়মন্ড হারবার রোডের ভিড় ঠেলে সড়কপথে পৌঁছতে ভুগতে হয় বিস্তর। এখনকার নিউ আলিপুরের কাছ থেকে তখন শুরু হত এই রেলযাত্রা। প্রথমে বেহালা ঘোলসাহাপুর থেকে ফলতা রুট শুরু হলেও পরে বাড়ানো হয় যাত্রাপথ। মাঝে ১৮ টি স্টেশনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছিল কালীঘাট, বেহালা ঘোলসাহাপুর, সখের বাজার, ঠাকুরপুকুর, পৈলান, ভাসা, আমতলাহাট, শিরাকোল, দিঘির পাড়, হরিণ ডাঙ্গা, ফলতা ইত্যাদি। চার পাঁচটি কামড়া নিয়ে শব্দব্রহ্ম তৈরি করে ছুটে যেত সাহেবের রেল৷ বাড়ির উঠোন থেকে টিকিট কেটে ড্রাইভারকে হাত দেখিয়ে ট্রেনে উঠতো মা ঠাকুমারা। কিন্তু আবার ঘুরেফিরে আসে সেই একই প্রশ্ন। কোথায় গেল ম্যাকলয়েড সাহেবের রেলগাড়ি। সকলের চোখের আড়ালে সে আজও চাপা পড়ে আছে নগরায়নে। আজ প্রসস্থ হাইওয়ের নীচে। তবু বেহালায় রিক্সায় উঠে আজও রেললাইন বললে চোখ বুজিয়ে পৌঁছে দেয় রিক্সাচালক। রেললাইনের ওপরে তৈরি রাস্তাই আজকের ব্যস্ততম জেমস লং সরণি। এই পথে আলিপুর থেকে ফলতা যাবার পথে আপনিও হয়ত নিজের অজান্তেই শুনতে পান ম্যাকলয়েড সাহেবের গাড়ির কুঝিকঝিক শব্দব্রহ্ম।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
https://x.com/KausikChak1234/status/1850500169957031976?t=L9P2_8d4D27bNVXYiUNKlQ&s=19
এই ইতিহাসটা তোমার মুখেই আগে শুনেছিলাম এখন পড়লাম৷ পড়তে পড়তে ভিসুয়ালাইজ করলাম কেমন ছিল সেই রেলপথ৷ সাহেবদের সাজানো শহর।
খুবই তথ্যবহুল পোস্ট শেয়ার করলে আমাদের সাথে। কলকাতার এমন গুপ্ত ইতিহাস আজ আর কজনেই বা জানে?
রেলের কামরাগুলো আজ আর নেই না আছে ঝিকঝিক ধোঁয়া তোলা শব্দ৷ ব্যস্ত সড়কে চাপা ম্যাকলয়েডের পদক্ষেপ।
হ্যাঁ এই ইতিহাস কলকাতায় এক হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। পড়ে এমন সুন্দর মন্তব্য করলেই বলে আমার পোস্টটি পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো।