সুমনের একদিন (পর্ব দুই) (১০%@shy-fox এবং ৫%@abb-achool)

পূর্বানুবৃত্তি :- গ্রামের ছেলে সুমন , শহরের চাকরি হারিয়ে হতাশ হয়ে প্লাটফর্মে বসে থাকে অনেকক্ষণ, পরিবারের সকলের চিন্তা তাকে গ্রাস করে, নিজেকে সামলে সুমন নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখে ,অনেকগুলো ট্রেন ছেড়ে দিয়ে অবশেষে একটি ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরার পথে পাড়ি দেয় সে...

                          পর্ব (২)

একটার পর একটা রেল স্টেশন পাড় হতে লাগলো। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে সুমন দেখতে লাগলো প্রকৃতি। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় সোনার বরণ হয়ে উঠেছে চারিদিক, শহরের কোলাহল পূর্ণ স্টেশন গুলো ছাড়িয়ে ট্রেন টা যত এগোতে থাকে তত সামনে হাজির হতে শুরু করে গ্রামের কোমল স্নিগ্ধতা।

railway-g5b7dfdacb_1920.jpg
Image source

মাঠ ঘাট জমিতে সূর্যের এই ম্লান আলো যেনো অদ্ভুত এক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। কতদিন চোখ মেলে প্রাণ ভরে এসব দেখা হয়নি, এতদিন তো সকালে অফিসে যাওয়ার তাড়া আবার দিনের শেষে সন্ধে উপস্থিত হলে ক্লান্তি বিষণ্ণতা নিয়ে সেখান থেকে বাড়ি ফেরার তাড়াহুরো। কতদিন পাড় হয়ে গেছে বিকেল টাকে আর তেমন ভাবে দেখা হয়না সুমনের, বহু দিন আগে যখন সুমন রত্নার সাথে প্রেম করত, হাতে হাত দিয়ে পড়ন্ত বিকেলে মাঠের পাশ থেকে দুজনে হেঁটে যেতো, তখনই এই বিকেল বেলার প্রকৃতিকে সে উপভোগ করতো । প্রিয়তমার সাথে দেখা সেই নরম রোদ ,হালকা ঠান্ডা বাতাসের অনুভূতি, সব স্মৃতি গুলো যেনো তার মণিকোঠায় উকি দিয়ে গেলো।
"একটু দরজা টা ছেড়ে দাড়াবেন"- পাশ থেকে পাওয়া শব্দে হঠাৎ সম্বিত ফিরল সুমনের। ঠিক ভাবে কথাটা শুনতে না পেয়ে সুমন নিজে থেকেই সামনে দন্ডায়মান ভদ্র লোক কে জিজ্ঞেস করলো, কিছু বলছেন? উত্তরে মাঝারি বয়সের মোটা কাচের চশমা পরা সেই ভদ্রলোক আবার বললেন, " বলছিলাম,দরজা টা একটু ছেড়ে দাড়াবেন, আমি রানা ঘাটে নামবো।"

people-g95fdd9e88_1920.jpg
image source

সুমনের দিবা স্বপ্নের ব্যাঘাত ঘটায় একটু গম্ভীর গলায় বলে উঠলো সে , "পিছনে অনেক জায়গা আছে, ওপাশ থেকে নামুন, আমি সরতে পারছি না!" সত্যি সত্যি পেছনে জায়গা আছে আগেই খেয়াল করেছিলো সেই ভদ্রলোক , কিন্তু যে উটকো মার্কা একটা ছেলে সেখানে দাড়িয়ে, তাতে আর তাকে সরতে বলার সাহস সেই ভদ্র লোকের হয় নি, পাশের ছেলেটিকে উটকো মনে করার যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে ,

stylish-gb5af0610e_1920.jpg
Image source

রঙিন চুলে অদ্ভুত বিলি কাটা, কান ভর্তি তিন চারটে কানের দুল, মুখ ভর্তি পান, পরনে ছেড়া জিন্স, হালের ফ্যাশন আর কি। তাকে সরতে বলে মুখ ঝামটা খাওয়ার চেয়ে সুমন কে দেখে তার সভ্য ভদ্র মনে হয়েছিল , তাই সুমনকেই তিনি একটু জায়গা ছাড়তে অনুরোধ করেছিল, তবে তার আশার যে এমন বিপরীত প্রতিক্রিয়া হবে লোকটি বোধ হয় কল্পনাও করতে পারেন নি। যাই হোক কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্রেনটি রানাঘাট স্টেশনে ঢুকলো। প্রচুর ভিড় সারা প্ল্যাটফর্ম জুড়ে, লোক গিজ গিজ করছে, জংশন বলে কথা। সকলেই ট্রেন ধরার ব্যস্ততায় রয়েছে, ট্রেন থামতেই যেনো হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়ে পড়লো সকলে ওঠার জন্য। সুমন কিন্তু খেয়াল করছিল সেই লোকটাকে প্রচন্ড ধাক্কাধাক্কিতে লোকটির পক্ষে নামা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছিলো, বেগতিক দেখে সুমন নিজের পেশী বল প্রয়োগ করে যেনো ভদ্রলোক কে রাস্তা করে দিল নামার। ভিড় ঠেলে তিনি কোনো মতে নামলেন। ট্রেন টা আবার চলতে শুরু করবে ঠিক তক্ষুনি সুমন খেয়াল করলো ভদ্রলোকের কাধেঁ এতক্ষন ঝুলে থাকা ব্যাগ টা স্ট্র্যাপ ছেঁড়া অবস্থায় পড়ে রয়েছে কম্পার্টমেন্টে। প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে দেখতেই সুমন দেখতে পেলো ভদ্রলোক ততক্ষনে ব্যাগ হারিয়ে ফেলার দুশ্চিন্তায় জবুথবু হয়ে গেছেন, মুহূর্তের মধ্যে কপালে এক অশনি চিন্তার ভাঁজ আর তার সাথে যোগ হয়েছে অসংখ্য স্বেদবিন্দু এবং চোখের কোনে জল। সুমন কোনোকিছু না ভেবেই ব্যাগটা তুলে নিয়ে এক লাফে নেমে পড়লো সদ্য গতি প্রাপ্ত ট্রেন থেকে। তারপর লোকজন কে টপকে পৌঁছে গেল সেই মাঝ বয়সী লোকটার দিকে। "এই নিন আপনার ব্যাগ, বগিতে পড়েছিল, বয়স হয়েছে এখনও কেনো যে একা একা চলা ফেরা করতে যান ! আমি আজ না থাকলেই আপনার ব্যাগের মালিক অন্য কেউ হয়ে যেতো। আপনার তো উপকার হলো, মাঝখান দিয়ে দেরী হয়ে গেলো আমার, আবার বসে থাকো কৃষ্ণনগর লোকালের অপেক্ষায় " - সুমন কথা টা শেষ করতে না করতেই ভদ্রলোক সুমনের হাত দুটো ধরে বলে ওঠেন - " তুমি আমায় বাঁচালে বাবা, ব্যাগটা হারিয়ে গেলে আমি তো আর বেঁচে থাকতাম কি না সন্দেহ! "
"চলুন তবে আপনার প্রাণ বাঁচানোর পুরস্কার হিসেবে এক কাপ চা খাওয়াবেন" - সুমন বলে ওঠে ভদ্রলোকটিকে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ অবশ্যই বলে ভদ্রলোক ও সুমন মিলে হাজির হয় প্ল্যাটফর্মের উপরে থাকা একটি চায়ের দোকানে।

tea-g65c414d80_1920.jpg
Image source

"বিশু, এদিকে দুকাপ চা দিস তো "- ভদ্রলোক বলে ওঠেন পরিচিত দোকানদারের উদ্দেশ্যে। দোকান দার ভদ্রলোককে দেখতে পেয়ে তার উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন, ' আরে গোবিন্দ দা যে, কত্ত দিন বাদে! ছেলে কেমন আছে এখন? ডাক্তার রা কি বলছে?'
সুমন ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো তার চোখে জল,পুরু কাচের চশমা টা খুলে চোখ মুছতে মুছতে তিনি দোকান দার বিশু কে জানায় ডাক্তার বলেছে, "পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার আশা খুব ক্ষীণ, কোমা থেকে কবে বেরোবে কিছুই সঠিক ভাবে জানাতে পারছেন না তারা, হয়তো ঠিক হলেও হুইল চেয়ার সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে।" কথা গুলো শেষ করতেই সারা চায়ের দোকান জুড়ে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সুমনের মুখ থেকেও যেনো কোনো কথা সরছিলো না, স্থির ভাবে তাকিয়ে ছিলো সে গোবিন্দ বাবুর মুখের দিকে।
(ক্রমশ)

Coin Marketplace

STEEM 0.18
TRX 0.14
JST 0.030
BTC 58559.96
ETH 3156.41
USDT 1.00
SBD 2.44