দুঃখে যাদের জীবন গড়া, তাদের আবার দু:খ কি?
হ্যালো বন্ধুরা। আমি ফরিদা ইয়াসমিন। বয়স ৫৪ বছর। এই ব্লকে এটাই আমার প্রথম লেখা। জানিনা সবাই আমাকে বন্ধু করে নিতে পারবেন কিনা। আজ আমি আমার জীবনের কিছু কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করবো।
মানুষের জীবনের পরিসরটা অনেক ছোটো। এই ছোটো পরিসরের অনেকটা পথ হেটেছি আমি দুঃখকে সঙ্গী করে। আমার বয়স যখন ছয়, তখন আমার মা নয় মাস অসুখে ভুগে মারা যান। আমরা এগার ভাই বোনের মধ্যে আমি নয় নম্বর। মা মারা যাওয়ার সময় আঠার মাস বয়সী আমার একটি ছোটো ভাই রেখে যান। আর মা মারা যাওয়ার আগে আমার বড়ো তিন বোনের বিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছিলেন। বাকি আট ভাই বোন সবাই প্রায় ছোট। ছোটো ভাইটিকে নিয়ে সবাই চিন্তিত। কী করে বাচাবে তাকে ! বাবা ব্যবসা করতেন নারায়ণগ শহরে। প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়ি আসতেন। সারা সপ্তাহ আমাদের রান্না করার কোনো লোক ছিল না। কারণ আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে এতগুলো ছেলে মেয়ের খাবার, কাপড় ও পড়ালেখার খরচ কুলাতেই বাবা হিমশিম খেতেন। তার মধ্যে কাজের লোক রাখা- সেতো অসম্ভব। এদিকে বিবাহিত তিন বোনের মধ্যে একেক জন এসে আট থেকে দশ দিন থাকতেন। একজন গেলে আরেক জন আসতেন। এভাবেই চলতে থাকে।
তিন চার বছর পর মেজবোনের শ্বাশুড়ি আমার বাবার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করেন। পরিবারে একটি স্বস্থির আভাস বইছে। বিয়ে হয়ে গেলো, আমার সৎ মা ঘরে আসলো। বিভষৎ চেহারা, কালো, সিগারেট খায়, আরো অনেক কিছু সে করতো। রান্না করলে তা মুখে তোলা যায় না। একদিন সে লাউ রান্না করে তাতে বিষ মিশিয়ে রাখলো। তখন আমার বড়ো ভাই পলিটেকনিক্যালে পড়েন। সে কলেজে যাওয়ার আগে খেতে বসে তা বুঝতে পারে। আমরা ছোটোরা সবা্ই স্কুলে। বড়োভাই আমাদের ফেরার সময় রাস্তায় এগিয়ে এসে বলেন ঘরে গিয়ে লাউ তরকারী খাবিনা। আমি খুব ছোটো তেমন কিছু বুঝতে পারলাম না। কিন্তু আমার ইমিডিয়েট ভাই বললো জানিস, আমাদের ডিইনি মা খাবারে বিশ মিশিয়েছে, ভুলেও কিন্তু খাবিনা। এরকম অনেক ঘটনা ঘটতে থাকলো বাড়িতে। আমরাও বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত মোকাবেলা করতে থাকলাম। বাবাও দিনে দিনে কেমন যানি হয়ে যেতে শুরু করলেন।
বছর খানেক পরের কথা
হঠাৎ করে বাবা আমাদের পাঁচ নম্বর বোনের বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। কারণ এই বোনই আমাদের ডাইনি মায়ের কার্র্কলাপ বুঝতো ও প্রতিবাদ করতো। চলে গেলো বোন শ্বশুর বাড়ি, আর আমরা রইলাম সেই ডাইনির কবলে। আমাদের বাড়ির আশে পাশে কোনো বাড়ি নাই । কারণ আমাদের বাড়িটা একটা বাগান বাড়ি। একটু দূরে ছিল আমার ছোটো খালার বাড়ি। আমার সৎমা সেখানে যাওয়া পছন্দ করতো না। কিন্তু আমার ছিল অনেক লম্বা চুল, যা ম্যানেজ করতে পরতাম না। সৎমাতো কোনোদিন তেল দিয়ে আচড়িয়ে দিতো না। ফলে এলোম্যালো চুলে স্কুলে যেতাম। তা দেখে ছোটোখালা ডেকে তেল দিয়ে আচড়িয়ে দিতেন। একদিন চুল বেধে দিলে পাঁচ ছয়দিন চলে যেত।
হঠাৎ একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘরে কিছুই নেই, সবকিছু এলোমেলো। আমরা আমাদের ডাইনি মাকে খুজতে থাকলাম। কোথাও পেলাম না। ঘরে বছরের যত ফসল তোলা ছিল, যেমন- ধান, গম, মুসুরের ডাল, সরিষা সব ড্রাম খালি । চালের কলসের চালও নাই। ঘরের ক্রোকারিজ, কাপড়, গয়না সবকিছু নিয়ে পালিয়েছে আমাদের ডাইনি মা। পরে শুনেছি তাকে কোথাও খুজে পাওয়া যায়নি।
আরও দুই বছর পরের কথা
ইতি মধ্যে আমার চার নম্বর বোন নারায়নগঞ্জ শহরে থেকে পড়াশোনা করেন। আমার বড়ো ভাইসহ আমরা ছোটো চার ভাই ও দুই বোন বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করি। বড়ো ভাই রান্না করেন। এখন আমি সকালের নাস্তা বানাতে পারি, কিছু কিছু রান্না করতে পারি। এখন আমার বয়স নয় হলেও আসলে অনেক বড়ো হয়ে গেছি। ছোটো ভাই বোনের যত্ন নিতে পারি, হারিকেন মুছে ধরাতে পারি। আরো কতো কিছু …..। এদিকে সবার পড়ার অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। আত্নীয়দের এক কথা, বাবাকে আবার বিয়ে করাতে হবে। যেই কথা সেই কাজ। আবার আমাদের ঘরে এলো এক সৎমা। আমরা সবাই ভয়ে তঠস্ত। কেমন হবে…… কী করবে…. ইত্যাদি ইত্যাদি। যাক আল্লাহ সহায়। এই মা আমার ডাইনি মা থেকে অনেক ভালো। দেখে আমাদের সবারই পছন্দ হয়েছে। সেও আমাদের ভালোবাসতে লাগলো। সমস্যা হলো সে অনেক চিৎকার করে কথা বলে ও বকবক করতেই থাকে। অনেকটা গোদের উপর বিশ ফোড়ার মতো। যাই হোক তারপরও ডাইনি থেকেতো ভালো !
ইতিমধ্যে আমার চার নাম্বার বোন ও বড়ো ভাইয়ের ঢাকায় চাকুরী হয়ে যায়। ভালোই চলছিলো আমাদের এই মায়ের সাথে চলা। আমিও ইন্টার পড়ি। এই সময় আমার এক সৎভাইয়ের জন্ম হয়। ভাইকে আমরা সবাই খুব ভালোবাসি। সেও আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না।
আমার সব ভাই বোনরা
ইন্টার পাশ করে আমি ঢাকায় চলে আসি। ডিগ্রি পাশ করে সংসারের কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে চাইলাম। তাই চাকুরী খুজতে লাগলাম। ভাবলাম চাকুরী পেলে অন্তত স্বাধীনভাবে চলতে পারবো। চাকুরী হলো ব্র্যাক নামে একটি এনজিওতে। পোস্টিং মানিকগঞ্জের ঘিওরে। সেখানে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। শুনে খুব খুশি হলাম। কিন্তু গিয়ে দেখলাম চাকুরী? সেতো অনেক কঠিন ডিউটি। সারে সাতটায় শুরু রাত আটটা পযর্ন্ত। ঝড়, রোদ, বৃষ্টি বলে কিছু নেই, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুড়ে বেড়াতে হয় অবিরাম। সাথে বন্ধু সাইকেল/মোটর সাইকেল। তারপরও সৎমায়ের ঘরে থাকার চেয়ে ভালোই লাগতো। একদিন নদী পার হচ্ছি খেয়াতে। আমি মোটর সাইকেল ধরে দাড়িয়ে আছি। এক বৃদ্ধ চাচা বললেন, মাগো যদি মেট্রিক পাস করতি তাহলে তো এমন কষ্ট করতে হতো না। মনে মনে বললাম চাচা, সৎমায়ের ঘরতো করেন নি, কি করে বুঝবেন, কষ্ট কী?
১৯৯৫ সালে আমার বিয়ে হলো । সংসারের টানে ঢাকায় বদলী হয়ে আসলাম। একে একে আমাদের দুটি সন্তান হলো। সুখেই চলছিল। কিন্তু দুঃখ যাদের জীবন সঙ্গী তাদের কী আর সুখ সয়। হঠাৎ আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ঘুড়ে চিকিৎসা চলছিল। এদিকে সংসার, চাকুরী, সন্তানদের পড়াশুনা ও স্বামীর অসুস্থ্যতা নিয়ে আমি আর পেড়ে উঠছিলাম না। কষ্টে কষ্টে কেটে গেল অনেকগুলো বছর।
২০১৬ সাল, আমার স্বামীর চাকুরী চলে গেল। ইনকাম বন্ধ, আমার একার ইনকামে স্বামীর চিকিৎসা, সন্তানদের পড়াশুনা, সংসার খরচ সব মিলিয়ে অথৈ সমুদ্রে পড়ে গেলাম। জমানো টাকা খরচ করে চলতে লাগলাম। কিন্তু তাতে কতদিন? স্বামী ৩টি গাড়ি কিনে ভাড়া দিলেন। এরমধ্যে আমি সখের বসে বেশ কিছুদিন রান্না শিখেছিলাম। আমি প্রায় আড়াইশো রকম রান্না পারি। ভাবলাম নিজের কিচেন ও ডাইনিং দিয়ে কিছু করা যায় কিনা। যেই ভাবনা সেই কাজ। শুরু করলাম রান্না শেখানোর স্কুল। ভালোই সারা পেলাম। সারা সপ্তাহ অফিস করে শুক্র – শনিবার রান্নার ক্লাশ। কিন্তু বিধিবাম, ঘরে ভালো ভালো রান্না হলে ঘরের মানুষকে না দিয়ে পারা যায়? এদিকে অসুস্থ স্বামীর অনেক সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তার বললেন বাইপাস করাতে হবে। আবার বিভিন্ন জায়গার ঘুরে( ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ) চিকিৎসা চল্ছে। বন্ধ হয়ে গেলো রান্নার স্কুল। একে একে বিক্রি হয়ে গেলো গাড়িগুলো। ভাবলাম স্বামী আমার বাঁচে কিনা, বেচে থাকতে মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়া দরকার। মেয়ে অনার্স থারড ইয়ারে পড়ে। দেখে শুনে অষ্ট্রেলিয়ায় সিটিজেন প্রাপ্ত এক ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিলাম। বিয়ের ২ সপ্তাহ পড়ে শুরু হলো সারা বিশ্বে কোভিড ১৯ মহামারি। মেয়ে জামাই তাড়াহুড়া করে চলে গেলো। এদিকে মেয়ের পড়াশুনা, স্বামীর অসুস্থতার সাথে যোগ হলো নতুন ইস্যু জামাতা প্রবাসে একা, তার চিন্তা।
আমাদের মেয়ে ও জামাই
কোভিড প্রথম ঢেউ পার হওয়ার পর আমার স্বামীকে ডাক্তার বললেন যত দ্রুত সম্ভব অপারেশন করাতে হবে। পাশাপাশি কোভিড ১৯ পরিস্থিতিতে আমার অফিস থেকে আমাকে আরলি রিটায়াডম্যান দিয়ে ছাটাই করে দিলো। চোখে মুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। চাকুরীটা থাকলে হয়তো স্বামীর চিকিৎসা খরচ কিছুটা স্বাস্থ্যবীমা থেকে পাওয়া যেত। কিন্তু সেই পথটাওতো বন্ধ হয়ে গেলো। যাহোক আল্লাহই একমাত্র ভরসা। আমার স্বামীর বাইপাস হলো, তারপর আমাদের দুজনেরই কোভিড ধরা পড়লো। সব মিলিয়ে তালগোল পাকিয়ে চলছিল। গাড়ী সবগুলো বিক্রি করে দিয়ে অসুস্থ্য মানুষটি ঘরে বসে লেখালেখি শুরু করলেন। কিন্তু তাতে কোনা ইনকাম নাই। এভাবেই চলছে।
আমার কোনো দুঃখ নাই
সবশেষে আমরা দুইজনেই ইনকাম শূন্য। ছেলে আমাদের সফটওযার ইন্জিনিয়ারিং পড়ছে। মেয়ে অষ্ট্রেলিয়ায়। আমার হাতে অফুরন্ত সময় কিন্তু কাজ নাই, ইনকামও নেই। তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। তাই অপনাদের জন্য লিখতে শুরু করলাম। আশা করি আমাকে আপনাদের বন্ধু করে নিবেন।
ধন্যবাদ
লেখার সুন্দর হাত। গুছিয়ে লিখতে পারেন দেখছি। সত্যিই করুণ কাহিনী। অনেকের জীবনেই বোধ হয় কম-বেশী এরকম বেদনাার্ত ও দু:খজনক ঘটনা জড়িয়ে থাকে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে তাদের বেড়ে উঠতে হয় ও সম-সাময়িক পরিস্থিতি মানিয়ে চলতে হয়। লিখুন প্রিয় লেখক, মনের মাধুরী মিশিয়ে আপন জীবনে ঘটে যাওয়া আপনার ঘটনা ও মূল্যবান অভিজ্ঞতা লিখুন। যতসব অসঙ্গতি তুলে ধরুন। আমরা আপনার সঙ্গে আছি। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ
সুন্দর মতামতের জন্য।
লেখাটি পড়লাম। জীবনের অনেক কঠিন সময় পার করেছেন ইতিমধ্যেই। যাইহোক আমার বাংলা ব্লগ কমিউনিটিতে আপনাকে স্বাগতম। আপনি ডিসকোর্ড সার্ভারে জয়েন হন । এখানে আমাদের @ayrinbd আপু আপনাকে হেল্প করবে।
সার্ভার লিঙ্ক: https://discord.gg/amarbanglablog
@adalyn12 জয়েন করুন discord এ, আর কমিউনিটি রিলেটেড যে কোনো কিছু জানতে discord এ কথা বলুন আমার সাথে।
discord কোথাও খুঁজে পাই না। একটু যদি বলতেন কীভাবে জয়েন্ট করবো।