পুরোনো ঢাকার অতীত ও বর্তমানের বিয়ের গল্প।-২
অনেকদিন আগে পুরোনো ঢাকার বিয়ে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। তখনই ভেবেছিলাম এর দ্বিতীয় অংশও লিখবো। এর জন্য লিখেওছিলাম। কিন্তু তারপর ভুলে গিয়েছি সেই লেখার কথা। আজকে আবার চোখে পরলো সেই লেখার বাকি অংশ । আমি পুরোনো ঢাকার মানুষ না। বিভিন্ন জায়গাতে এসম্পর্কে পড়েছি আবার অনেক সময় নিজেও অংশ নিয়েছি। সেই সব লেখা ও অভিজ্ঞতার সারমর্ম এই লেখা।
আমাদের দেশে সাধারণত দেখা যায় বিয়েতে দুই বাড়িতেই হলুদের অনুষ্ঠান , বিয়ে আর বৌভাতই হয়ে থাকে। ইদানিং অবশ্য মেহেদী ,সংগীত ইত্যাদি যোগ হয়েছে। কিন্তু পুরোনো ঢাকার বিয়েতে অনেক আগে থেকেই এসবের সাথে সাথে সন্ধ্যাকোটা, দই -ভাত ইত্যাদির অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ঐতিহ্যগত ভাবেই পুরান ঢাকার মানুষ উৎসব প্রিয়।
এই এলাকার বিয়ের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় , বিয়ের নানা আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতো অনেকদিন আগে থেকেই। বরপক্ষ যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে কনের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিত সেদিন থেকেই মূলত বিয়ের উৎসব শুরু হয়ে যেতো। এই অনুষ্ঠানকে ‘পানচিনির’ অনুষ্ঠান বলা হতো ।অবশ্য পান চিনি আরো অনেক এলাকেই প্রচলিত ছিল।
সেকালে পারিবারিক পছন্দ ও আয়োজনেই বিয়ে সম্পন্ন হতো।আর এ ক্ষেত্রে ঘটকের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পাত্র-পাত্রীর খোঁজ থেকে শুরু করে বিয়ে সম্পন্ন করা পর্যন্ত সব জায়গাতেই ছিল ঘটকের উপস্থিতি । ঢাকাইয়া ভাষায় ঘটককে বলা হয় ‘মোতাসা’। মূলত এঁরা ছিলেন পেশাজীবী ঘটক।
পানচিনি কিংবা পাকাকথার অনুষ্ঠানে বর-কনে উভয় পক্ষের বিভিন্ন প্রস্তুতি থাকত এবং বরপক্ষের যাঁরা কনের বাড়িতে যেতেন তাঁরা সাথে করে নিয়ে যেতেন নানা ধরনের মিষ্টি এবং পান-সুপারি। এসব জিনিস বেশি নেওয়ার সাথে একটি আভিজাত্যের প্রশ্ন জড়িত ছিল। পান-চিনির এই অনুষ্ঠান শেষে কনেপক্ষ তাদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে এসব মিষ্টি ও পান-সুপারি পাঠিয়ে বিয়ের পাকা কথার সুসংবাদ জানাত।
এই অনুষ্ঠানে বর নিজে আসতে পরত না। কনের বাড়ির লোকজন এদিন বরপক্ষের অতিথিদের নানা পদে বিশেষ আপ্যায়নের আয়োজন করত।
এখনকার বিয়ের দাওয়াত কার্ডে দেয়ার প্রচলন থাকলেও আগে বিয়ের দাওয়াত পুরান ঢাকায় পান সুপারী অথবা রুপার বাটিতে রাখা রংগীন কাগজে মোড়ানো পয়সা দিয়ে বিয়ের নেওতা বা দাওয়াত দেয়া হইতো ।
পুরোনো ঢাকার বিয়েতে সাধ্যাতিরিক্ত দান সামগ্রী বরের বাড়িতে পাঠানো আভিজাত্যের লক্ষণ ছিল। এসব সামগ্রী কুলির মাথায় সদর রাস্তা দিয়ে মিছিল করে পাঠানো হতো। এই জিনিসটা এখনো প্রচলিত আছে। আমাদের বাড়িওলার মেয়ের বিয়েতে পিকআপ ভ্যান দিয়ে ছেলের বাড়ি থেকে জিনিসপত্র পাঠাতে দেখেছি। আবার কয়েকবছর আগে লাইন করে ভ্যান ভর্তি করে করে ইফতার পাঠানোর ভিডিও ভাইরাল হতে দেখেছিলাম সোশ্যালমিডিয়াতে।
বর্তমানে ‘নাইওর’ প্রথাটি এখন প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এককালে ঢাকার বিয়েতে বিয়ে অনুষ্ঠানের অনেক আগে থেকে নিকটাত্মীয় নাইওরিরা এসে জমজমাট করে রাখতো বিয়েবাড়ি। মেয়েরা গোল হয়ে বসে বিয়ের গীত গাইত আর সে যুগেও বিয়ের আগে গায়ে গলুদ একটি জমজমাট আনন্দ অনুষ্ঠান ছিল। দুই-তিনদিন ধরে বর-কনের গায়ে হলুদ চলত। ঢাকাবাসী এই আয়োজনকে ‘তেলাই’ বলে থাকেন।
এই গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের জন্য বরপক্ষ কনের বাড়িতে মিষ্টি, মাছ এবং কাপড়সহ হলুদের প্রয়োজনে ব্যবহৃত নানা দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে যেত। যত কিছুই নেওয়া হোক না কেন, দই এবং বড় আকারের দুটো মাছ অবশ্যই নেয়া হতো । মাছের একটিকে ধরা হতো বর আর অন্যটি ছিল কনের প্রতীক। মাছ দুটোকে সাজানোও হতো সেভাবেই। এই মাছ যে কাটবে তার জন্য মাছের মুখের ভেতর গুজে দেওয়া হতো টাকা। মাছ কাটতে গেলে সেই টাকা বেরিয়ে আসত।
আর নাইওরিতে আসা মেয়েরা উৎসাহের সাথে এই মাছ কাটা, হলুদ বাটায় অংশ নিত। হলুদ মাখামাখি এবং রং ছিটানোতে আত্মীয়স্বজনরাও অংশ নিত।মিরাশিন নামের নাচ ও গানের দলকেও আমন্ত্রণ জানানো হতো।
সেকালে বিয়ে বাড়ির সাজসজ্জায় কোনো ডেকোরেটরের প্রয়োজন ছিল না বরং আত্মীয় -পরিজন ও পাড়ার যুবকরা উৎসাহের সাথে এ কাজে লেগে যেত। রঙিন কাগজ কেটে ঝালর পতাকা ইত্যাদি বানিয়ে সদর রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত ঝলমলে করে তুলে হতো ।বিয়েতে অথবা বিয়ে উৎসবের রাতে হাউই বাজি ও ফানুস ওড়ানোর রীতিও প্রচলিত ছিল।
বিত্তশালীদের বিয়ের অনুষ্ঠানে বরযাত্রী টমটম গাড়িতে চড়ে কনের বাড়িতে যেত আর কনের বাড়ি বুড়িগঙ্গার ওপারে হলে নৌকা সাজিয়ে যাওয়া হতো। ‘প্রীতি উপহার’ বিতরণের রেওয়াজ ছিল বিয়ের আসরের একটি আবশ্যিক অংশ । রঙিন কাগজে ছাপা এক পক্ষ অন্য পক্ষের উদ্দেশে ব্যাঙ্গাত্মক করে লেখা কথামামালা থাকত এই প্রীতি উপহারে।বিয়ের পরও মাসখানেক চলতে থাকে উৎসবের এই আমেজ।
তবে পুরোনো ঢাকার একাল আর সেকালের বিয়ের একটা মিল আজও রয়ে গেছে। যতদিন বর কনের বাড়িতে বাজার না করবে ততদিন পর্যন্ত নতুন জামাইকে শুধু মোরগ পোলাউ খাওয়ানো হবে। এটা বাজার না করার অপরাধে নতুন জামাইয়ের শাস্তি।