এলপিজি সিলিন্ডারকে সিএনজি সিলিন্ডারে রূপান্তরিত করার মতো বোকামিতে ভয়াবহ দূর্ঘটনা ।
দূর্ঘটনার ঠিক আগ মূহুর্তের ছবি।সিসিটিভি ফুটেজ থেকে নেয়া স্ক্রিনশট |
---|
গত শুক্রবার আমার গ্রামের বাড়ি ধামরাই যাওয়ার কথা
ছিলো। কিন্তু শরীর খারাপ থাকার কারনে মানা করে দিয়ে বলেছিলাম যে, সম্ভব হলে আগামী কাল যাব। পরে মনে হয়েছিলো যে, না গিয়ে ভালো কাজ করেছিলাম। কারন গেলে আমাকে যে মর্মান্তিক দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হতো সেটা থেকে বেচে গিয়েছি।
ধামরাইতে আমাদের সিএনজি পাম্প স্টেশন আছে।আমাদের মানে আমার ভাইদের। পাশেই আমার নিজেরও কয়েকটা দোকান আছে। এজন্যই ধামরাই গেলে ওই জায়গাতে যাওয়া হয়।
শুক্রবার অন্য দিন গুলোর মতোই স্বাভাবিক দিন চলতেছিলো। দুপুরবেলা আমার ভাইয়ের দুই ছেলে এসে হাজির।আমাকে খানিকটা উত্তেজিত কন্ঠে এসে বলতেছে যে, বাবা ধামরাই গেছে। সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়ে অন্য একজন মানুষ মারা গেছে এজন্য। মানুষটার মাথা আর হাত নেই ,ওড়ে গেছে। এটা শোনার সাথে সাথে আমার হাত -ঠান্ডা হয়ে এলো।
কারন বেশ কয়েক বছর আগে আমি এক সিলিন্ডার ব্লাস্ট হওয়ার কাছাকাছি দূরত্বে ছিলাম।তখন সেই বিস্ফোরণ এর সাউন্ড আর শক-ওয়েভ দেখেছিলাম।মনে হচ্ছিলো ভূমিকম্প হচ্ছে। রাস্তার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে চায়ের দোকানে বসা তিনজন মারা গিয়েছিলো সেদিন।সাথে কয়েকজন আহতও হয়েছিলো।
আমার ভাগ্নের কাছ থেকে শোনে আমার ভাইকে কল দিলাম। ও বললো যে, যে মারা গেছে তার গাড়িতে এলপিজি গ্যাসের সিলিন্ডার লাগানো ছিলো। আমাদের পাম্প হলো সিএনজি গ্যাস স্টেশন। এই ভদ্রলোক তার গাড়ির এলপিজি সিলিন্ডারকে বেআইনীভাবে সিএনজি গ্যাস সিলিন্ডার এ রূপান্তরিত করেছে। এলিপিজি গ্যাস সিলিন্ডার খুব পাতলা হয়। আর পক্ষান্তরে সিএনজি গ্যাস সিলিন্ডার অনেক পুরু হয়। সেই সাথে আরও একটা জিনিস হলো, এলজিপি গ্যাসের প্রেশার হলো ৫ পিএসাই কিন্তু সিএনজি গ্যাস এর প্রেশার হলো ৩০০০ পিএসআই।
যার কারনে গাড়িতে গ্যাস এর নজেল লাগানোর ১০সেকেন্ডের মাঝে বিস্ফোরণ ঘটে। ভাগ্যক্রমে পাম্পের যে কর্মচারী নজেল লাগিয়েছিলো সে নজেল লাগিয়ে এর আগের গাড়ির টাকা জমা দিয়ে ক্যাশে জমা দেয়ার জন্য এগিয়ে গিয়েছিলো। এর কারনে সে বেঁচে গিয়েছে।
বিস্ফোরিত হওয়ার সময়কার ছবি।সিসিটিভি ফুটেজ থেকে নেয়া স্ক্রিনশট |
---|
পরে আরো জানতে পারলাম যে, আজকেই সে এই সিলিন্ডার কনভার্ট এর কাজটা করেছিলো। টেস্ট করার উদ্দেশ্য নিয়ে পাম্পে এসেছিলেন । অন্য দিকে পাম্প এর কর্মচারী এই ঘটনা না জেনে সরল মন নিয়ে গ্যাস দিতে গিয়েছিলো। নিয়ম হলো গ্যাস দেয়ার সময় গাড়ি থেকে নেমে দূরে অবস্থান করা।কিন্তু সিসিটিভি ফুটেজ এ দেখলাম এই ভদ্রলোক গাড়িএ পেছনে গিয়ে উঁকি দিয়ে সিলিন্ডার দেখতে গিয়েছিল।
দূর্ভাগ্যক্রমে গ্যাস নিতে আসা এক গাড়ির ড্রাইভারও এগিয়ে গিয়ে দেখতে গিয়েছিল। সে-ও আহত হয়েছেন। আরো একজন এর খানিকটা কেটে গেছে কয়েক জায়গাগে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখলাম এই গাড়িতে গ্যাস এর নজেল দেয়ার সামান্য আগেই দুজন মহিলা আর তাদের দুইটা বাচচা নিয়ে এই গাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিলো।দূর্ঘটনা কবলিত গাড়িতে গ্যাস এর নজেল লাগানোর কয়েক সেকেন্ড আগেই তারা তাদের গাড়িতে ওঠেছে।
দূর্ঘটনার ঠিক পর মূহুর্তের ছবি।সিসিটিভি ফুটেজ থেকে নেয়া স্ক্রিনশট |
---|
শোনলাম আইসিইউতে আছেন সে।
আমাদের পাম্প এর তেমন কোন ক্ষতি হয় নাই।কারন মাইক্রোবাস হওয়ার কারনে গাড়িটার সাইজ খানিকটা বড়ো সেইসাথে গ্যাস নেয়ার সময় নরমালি গাড়ি যেখানে দাড়িয়ে থাকে তার থেকে একটু পিছিয়ে দাড়িয়েছিলো।
যার কারনে মেশিনের তেমন কোন ক্ষতি হয় নাই। আর পেছনে একটা প্রাইভেট কার দাঁড়িয়েছিলো সেটারও তেমন একটা ক্ষতি হয় নাই।তবে রক্ত, মাংস আর ভাঙ্গা গাড়ির খন্ডাংশ ছিটকে গাড়ির ওপরে গিয়ে পরেছে।
আইসিউতে থাকা হতভাগ্য সিএনজি চালকের সিএনজি । |
---|
তারপরও ভাগ্য ভালো বলা যায় যে, আশেপাশে লোকজন তেমন একটা ছিলো না।আর সবচেয়ে যে জিনিটার কারনে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে সেটা হলো, ইদানীং সিএনজি পাম্পগুলোতে গ্যাসের প্রেশার নেই বললেই চলে। স্বাভাবিক যে প্রেশার থাকার কথা সেই থাকলে মেশিন সহ সিএনজি পাম্প এর ছাদও উড়ে যেত। প্রেশার কম তারপরও সিলিন্ডার গিয়ে পাম্পের ছাদে গিয়ে আঘাত করে এই ভদ্রলোক এর মাথায় গিয়ে পরে।আমি পরেরদিন গিয়ে দেখলাম পাম্পের ছাদে ছোপছোপ রক্ত লেগে আছে।
বিস্ফোরিত সিলিন্ডার । |
---|
আমার ভাই পুলিশকে কল দিয়ে জানালে তারা এসে সিলিন্ডার চেক করে দেখতে পায় সিলিন্ডার জোড়া দেয়া। যেখানে জোড়া দেয়া সেখান থেকেই বিস্ফোরণ এর সূত্রপাত।
ভাবতে অবাক লাগে যে, একজন শিক্ষিত মানুষ খরচ বাচাতে গিয়ে কিভাবে এত বোকার মতো সিদ্ধান্ত নেয়।আর্থিক অবস্থা খারাপ হলেও মেনে নেয়া যেত। সিলিন্ডার চেঞ্জ করার কথা তার পারিবার এর মানুষ জানতো তাই তারা মামলার দিকে যায় নাই। এরপর দুদিন বন্ধ ছিলো আমাদের পাম্প স্টেশন। সোশ্যাল মিডিয়াসহ অন্যান্য মিডিয়াতেও সিলিন্ডার চেন্জ করার কথাই আসে।
এরপরও আমরা সবাই চিন্তার মাঝে ছিলাম যে, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লোকজন এসে কি সিদ্ধান্ত নেয় এটা নিয়ে। কিন্তু তারা এসে বলেন যে, দোষ আমাদের না তাই পাম্প চালু করতে বলে যায়।
দুঃখজনক এই ঘটনার সাক্ষি যেন আর কখনো না হতে হয় এটাই কামনা করি সেই সাথে এই রকম বোকামীও যেন আর কেউ না করে
দূর্ঘটনার পরের দিনের চিত্র । |
---|
Camera | iPhone 14 |
---|---|
Photographer | @sayeedasultana |
Location | Dhaka,Bangladesh |
এমন একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা পড়ে খুবই দুঃখ পেলাম। মানুষের অসচেতনতা ও কিছু ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত কতোটা বিপজ্জনক হতে পারে, তা এই দুর্ঘটনা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। সিলিন্ডার রূপান্তর নিয়ে সাধারণ মানুষের অসচেতনতা ও ঝুঁকির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর। আল্লাহ সেই মানুষটির পরিবারকে ধৈর্য দান করুন এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য দিন।
একদম ঠিক কথা বলেছেন ,সামান্য ভুল সিদ্ধান্ত আর অসচেতনতা মুহূর্তের মাঝে এক বিরাট ক্ষতির কারণ হতে পারে। আমাদের দেশের গাড়িগুলি আসলে একেকটা চলন্ত বোমা। একবার সিলিন্ডার লাগানোর কিছু বছর পরে চেঞ্জ করা প্রয়োজন। কিন্তু এবিষয়ে সরকার ও গাড়ির মালিক উভয়েই উদাসীন। ভবিষ্যতে ভয়াবহ খেসারত দিতে হবে এজন্য।