"সমাজের কিছু অযৌক্তিক নিয়ম, কত মানুষের জীবন থেকে তাদের ভালোবাসার রঙ কেড়ে নেয়"
|
---|
Hello,
Everyone,
কিছুদিন আগের পোস্টে আপনাদের জানিয়েছিলাম, বিশেষ প্রয়োজনে দিদির বাড়িতে মাঝে দুদিন আমাকে থাকতে হয়েছিলো। দিদি বাড়ি থেকে ফেরার সময় আমি বরাবর ট্রেনে ফিরতে পছন্দ করি এবং এবারও তাই করেছিলাম।
বেশিরভাগ দিন বিকেলের দিকেই ফেরা হয়, তবে এবার বিশেষ দরকার থাকার কারণে আমাকে রবিবার সকালেই ফিরতে হয়েছিলো। সেদিন ছিলো রবিবার, তার ওপর আবার সকাল বেলা, তাই তুলনামূলক ভিড় একটু কমই ছিলো, ।
যাইহোক আমি উঠেই সিট পেয়ে গিয়েছিলাম এবং দুটো স্টেশন অতিক্রম করার পর একজন ভদ্রমহিলা উঠলেন এবং তিনি আমার সামনের সিটে বসলেন।
একটু বাদে তার ফোনে কেউ একজন ফোন করেছিলেন, কথোপকথন শুনে যা বুঝলাম, তিনি কোনো একটা বাড়িতে রান্নার কাজ করেন। আর কাজ শেষ করে প্রতিদিন এই সময় তিনি বাড়িতে ফিরে যান।
যাইহোক আমাদের এদিককার ট্রেনে আপনি চাইলে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসের পাশাপাশি, পুরো সংসারের জিনিসপত্র কিনতে পারবেন। সেটা জামাকাপড় থেকে শুরু করে সবজি, রকমারী খাবার, সাজগোজের জিনিস, ঘর সাজানোর জিনিস পত্র সমস্ত কিছুই মোটামুটি ট্রেনে পেয়ে যাবেন। আর যারা প্রতিদিন যাতায়াত করে হকারদের সাথে তাদের মুখ পরিচিতিও আছে।
কিছুক্ষণ বাদে একটা পেয়ারাওয়ালা উঠেছিলো, আর তার কাছ থেকে ওই মহিলা দুটো পেয়ারা কিনলেন। খাওয়ার পর পেয়ারাগুলো যে সুস্বাদু নয়, সেটা তিনি আমাকে জানালেন। কোনো বয়স্ক মানুষ যেচে কথা বললে, তার উত্তর না দেওয়াটা তাকে অপমান করা, তাই আমিও একটু হেসে মাথা নাড়লাম।
|
---|
যাইহোক কিছুক্ষণ বাদে একজন মহিলা হকার উঠলেন এবং তিনি ব্লাউজ বিক্রি করছিলেন। আমার সামনে বসে থাকা মহিলাটি সেই ব্লাউজ বিক্রেতা মহিলাদেরকে ডাকলেন এবং জানতে চাইলেন উনার কাছে হাতা কাটা ব্লাউজ আছে কিনা। তিনি বললেন আছে।
তারপর তিনি আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আসলে রান্নার কাজ করি তো, প্রচন্ড গরম লাগে তাই লজ্জা লাগলেও হাতা ওয়ালা ব্লাউজ পরতে পারি না। আমি আবারও একটু হেসে দিলাম।
আসলে উনি এইভাবে বারবার কথা বলছিলেন তাতে একটু অবাক হচ্ছিলাম ঠিকই, কিন্তু উঠে অন্য কোথাও গিয়ে বসাটাও ওনাকে অপমান করা হতো, তাই সেখানেই বসে রইলাম।
যাইহোক ব্লাউজ বিক্রেতা মহিলা এক বান্ডিল ব্লাউজ বের করলেন, যার ভিতরে বেশিরভাগ রং ছিল লাল,গোলাপি ও খয়েরী ধরনের। তবে ওই মহিলাটি অন্য কোনো রঙের ব্লাউজ দেখানোর কথা বলছিলো। সে কথা শোনার পর বিক্রেতা মহিলা বলছিল কেন, এই রংগুলোতে সমস্যা কোথায়?
তার উত্তরে সামনে বসে থাকা ভদ্র মহিলা বললেন- "যে রং ভগবান সারা জীবনের মতো কেড়ে নিয়েছে, তাই সেই রঙের ব্লাউজ পছন্দ হলেও পড়ার উপায় নেই।"
এই কথা শুনে আমি অবাক হয়ে মহিলাকে একবার ভালো করে দেখলাম এবং বুঝলাম তিনি বিধবা। একগাল হাসিমুখ নিয়ে বললেন,- "কোন ছোট বয়সে শশুর বাড়ি এসেছি এখন আর মনে নেই। কতো কম বয়েসে জীবন থেকে লাল রঙ উঠে গেলো। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত লাল রঙের কিছুই পড়ি না। জামাই মেয়ে কত বকাবকি করে। বলে লাল না পরো, অন্তত গোলাপী, খয়েরি এগুলো পরলে সমস্যা কোথায়? কিন্তু আমার কেন জানিনা মন মানে না। তাই ঐ রঙ একেবারেই বাদ দিয়ে দিয়েছি।"
পাশাপাশি এটাও জানালেন, ওনার সব থেকে প্রিয় রং ছিল এই লাল। ছোটবেলায় লাল, গোলাপি এইসব রং এর জামাকাপড়ি বেশি পড়তেন। ওনার যখন বিয়ে হয় তখন বাবার বেনারসি শাড়ি কেনার মত সাধ্য ছিলো না, তবে বেশ কয়েকটি সুতির লাল শাড়ি কিনে দিয়েছিলেন।
বিয়ের পরেও যত শাড়ি কিনতেন, সবই প্রায় লাল রঙ ঘেষা। তারপর একদিন সব শেষ হয়ে গেলো। আলমারির সমস্ত লাল রংয়ের শাড়ি গুলো ননদরা নিয়ে গেছে। তখন থেকে তিনি লাল রঙের জিনিস পড়া বাদ দিয়েছেন।
তবে মেয়েকে আজও যখন তিনি শাড়ি দেন, তিনি লাল রঙেরই দেন। এইসব কথা বলতে বলতে প্রায় নিজের গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন দত্তপুকুরে বাড়ি কিনা। আমি বললাম হ্যাঁ শশুর বাড়ি। তিনি বললেন, -"মেয়েদের আর বাড়ি কোথায় মা। হয় বাপের বাড়ি, না হয় শশুর বাড়ি।"
আমিও একগাল হেসে মাথা নাড়লাম। বড়ো সত্যি কথা বলেছেন। উনিও দত্তপুকুরেই নামলেন। হয়তো ওনারও এখানে বাড়ি। আমি আর আলাদা করে জিজ্ঞাসা করিনি। কারণ ততক্ষণে আমার মাথায় অন্য কিছু ঘুরছিলো।
|
---|
ওনার সমস্ত কথোপকথন গুলো আমার চোখের সামনে আমার ঠাকুমার কথা মনে করাচ্ছিলো। আমরা ছোটবেলা থেকে ঠাকুমাকে কখনো কোনো রঙিন শাড়ি পরতে দেখিনি। লাল তো দূরে থাক। উনি বরাবর সাদা রঙের ধুতিগুলো পড়তো, যেগুলোর সরু পাড় থাকতো। কারন, ঠাকুরদা যখন মারা যায়, বাবার বয়স তখন ৪ বছর।
|
---|
আমার ঠাকুমায়েরও হয়তো এমনই লাল রং পছন্দ ছিলো। তিনিও হয়তো রঙীন কাপড় পরতে ভালোবাসতো। কিন্তু সমাজের কিছু অযৌক্তিক নিয়মের কারণে, আজীবন তার ভালো লাগা প্রকাশ করার সুযোগও তিনি পাননি। আমরাও কখনো ওনাকে জিজ্ঞাসা করিনি, ওনার অন্য কোন রং পছন্দ ছিলো। ছোটবেলা থেকেই যেন সাদা রঙটাকেই ঠাকুর মায়ের পছন্দের রঙ ভেবেছি।
কি অদ্ভুত তাই না?
আগেকার দিনের মহিলারা কত নিষ্ঠা সহকারে বৈধব্য জীবনযাপন করতো। আজকাল তো তা প্রায় চোখেই পড়ে না। অনেকে তো বিয়ের পরেও শাঁখা সিঁদুর পড়ে না, পছো রং ত্যাগ করা তো দূরে থাকুক। অথচ আমার ঠাকুমার মতন মানুষেরা সারা জীবন নিজেদের কত ভালো লাগাই না বিসর্জন দিয়েছে, অথচ সেগুলোর মূল্যায়ন আমরা কখনোই করিনি।
ঐ অচেনা মহিলার কথাগুলো আমাকে বেশ ভাবিয়েছে। ওনার সাথে এই ক্ষনিকের পরিচয়, অনেক কিছু শিখিয়ে দিলো। আসলে যে নিয়মের কারনে, একজন মানুষের মৃত্যুর পর, অন্য একটা মানুষের বেঁচে থাকাকেও মৃত্যুসম করে তোলে, সেই নিয়মটি সত্যিই পরিবর্তন করার প্রয়োজন।
|
---|
তবে এই পরিবর্তন যদি আরও আগে থেকে শুরু হতো, তাহলে হয়তো ওই মহিলাটি বা আমার ঠাকুর মায়ের মতন কিছু মানুষকে, নিজেদের জীবন থেকে পছন্দের রং এর পোশাক অন্তত বাদ দিতে হতো না।
কয়েক বছর আগে খবরে দেখেছিলাম। কোনো একটি বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষ নিজেদের উদ্যোগে ওই বৃদ্ধাশ্রমে থাকা সমস্ত বিধবাদের নিয়ে,দুর্গাপুজোর সময় কোনো একটি প্যান্ডেলে গিয়েছিলেন বিসর্জনের দিন। সেখানে প্রাণ খুলে ওই বিধবাদের সিঁদুর খেলতে দেওয়া হয়েছিল।সিঁথিতে না হোক, অন্তত গালে লাগুক পছন্দের রঙ, মন খুলে আনন্দ করুক তারাও, এটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।
বিষয়টি নিয়ে অনেক সমালোচনা করলেও, কিছু মানুষ কিন্তু ঐ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ছিলেন। এবার বিবেচনা আমাদের কাছে, আমরা নিজেদের কোন দলে সামিল করতে চাই।
আপনাদের মতামত কমেন্টের মাধ্যমে অবশ্যই জানাবেন। ভালো থাকবেন সকলে। শুভরাত্রি।
এই নিয়ম গুলো একটি সময় মানুষ খুবই মেনে চলেছে। কিন্তু বর্তমানে যেদিন যাচ্ছে এই নিয়ম গুলো মানুষ খুবই কম মানে। আপনার আজকের এই পোস্ট পড়ে বুঝতে পারলাম আগে কার মানুষ কতোটা নিয়ম মেনে চলতো। এবং এটাও জানতে পারলাম আপনার বাবার বয়স যখন চার বছর তখন আপনার ঠাকুরদা মারা যান তারপর থেকে আপনার ঠাকুমা আর কখনো লাল রঙের বা কোন রঙের কোন জামা শাড়ি গায়ে দেন নেই।
আমি অনেক মেয়ে দেখেছি এখন বর্তমানে বিয়ের পরে তারা শাখা সিদুর মাথায় দেয় না। এই সব নিয়ম গুলো এখন বর্তমানে মানুষ খুবই কম পালন করতে আমরা দেখতে পাই। যাইহোক একটি সুন্দর লেখা আমাদেরকে উপহার দেয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
অনেক অনেক ধন্যবাদ এত সুন্দর একটা টপিক নিয়ে বাস্তবতার নিরীখে এত সুন্দর উপস্থাপনের জন্য। আসলে এই সবই আমাদের চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের জরাজীর্ণ সমাজব্যবস্থার চিত্র। কারো হাজবেন্ড মারা গেলেই যেন তার জীবনের রঙ্গিন পোশাক পড়া হারাম হয়ে যায়, এটা আসলে কেমন নিয়ম আমারো জানা নেই। আমার দাদী নানিকেও দেখেছি সাদা পোশাক পরতে, একটু রঙিন প্পোশাক পড়লেই পুরো গ্রাম যেন ছি ছি করা শুরু করে দিবে, কি নিয়ম।
সত্যি কথা বলতে আপনার পুরো পোষ্টটি পড়ার পর মাথার মধ্যে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক করছিল। যদিও বর্তমান সমাজের শহরের মানুষজন এসবের সঙ্গে বেশিটা জড়িত নয়। কিন্তু সেই আগের যুগের মানুষেরা, বিশেষ করে গ্রামের মানুষজন সেই প্রচলনটা এখনো ধরে রয়েছে।
স্বামী মারা যাওয়ার পর অনেকেই রঙ্গিন পোশাক পড়া বাদ দেয়। এটা কতটুকু সঠিক তা নিজেও জানিনা।
সুন্দর একটি বিষয় নিয়ে পোস্ট শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
আপনি আপনার লেখায় পুরুষশাসিত সমাজের একটা বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। এর পেছনে বেশ কিছু কারণের কথা পড়েছিলাম। শুধুমাত্র রঙিন কাপড় নিষিদ্ধ হলে তো ভালোই হতো।
আমার ছোট বেলাতে এমন দুই একজনকে দেখেছি যাদের চুল প্রায় ন্যাড়া করাই বলা যায় বিধবা হওয়ার অপরাধে। এদের মাছ মাংস ,পেঁয়াজ ,রসুন খাওয়াও নিষিদ্ধ করা হতো যাতে শারীরিক চাহিদা না বৃদ্ধি পায়। ভাবলে কষ্ট লাগে।
এখন যদিও কমে এসেছে তারপরও অনেক সময়ই চোখে পড়ে এমন দুই একজনকে।
ভালো লাগলো আপনার লেখা পড়ে।
ভালো থাকবেন সবসময়।
আপনি আপনার ঠাকুরমা সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলো আসলে ঠিক কথাই বলেছেন।
আগেকার সময় মানুষ অনেক কিছুই নিয়ম কারণ মেনে চলতো কিন্তু এখনকার সময় এসব কিছুই মানে না। এখন যে যার মতন চলতে পছন্দ করে এখন যে যার মতন তার পছন্দের রং কিংবা পছন্দের সকল কিছু করতে পছন্দ করে।
যাইহোক আপনি আপনার পোষ্টের ভিতরে যে উল্লেখিত কথাগুলো বলেছেন সেগুলো আসলে অনেক সুন্দর ছিল আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই এত সুন্দর কিছু বিষয়ে আমাদের মাঝে শেয়ার করার জন্য।
এটাতো শতভাগ সঠিক যে নারীরা এখনো অনেক কারণে আবদ্ধ যেটা এক কথায় নারী জাতিকেই পরাধীন করে রেখেছে। একটা সময় তো মৃত স্বামীর সাথে জীবিত স্ত্রীকেও দাহন করা হতো। এটা কতোটা জঘন্য চিন্তা করলেই আতঙ্কিত হতে হয়।
পাশাপাশি একটা বিষয় আরো ভালো লাগলো যে বৃদ্ধাশ্রম থেকে এভাবে পূজোতে যাওয়া এবং সিঁদুর খেলায় অংশগ্রহণ করা। আদেও কি কখনো নারী স্বাধীনতা পাবে?
আসলে আজকে আপনার পোস্টে ওই মহিলার কথাগুলো পড়ার পর, নিজের কাছেও বেশ খারাপ লাগলো। কিছু নিয়ম মানুষের জীবনের ভালোলাগা ভালোবাসার জিনিস গুলোকে, একেবারেই কেড়ে নিয়ে যায়। আপনার ঠাকুমার মত আমিও ছোটবেলা থেকেই আমার দাদি মাকে সাদা কাপড় পরতে দেখেছি। তবে তিনি বিভিন্ন ধরনের কাপড় পড়তেন।তবে সাদা কাপড় অনেক বেশি পড়তেন। কেননা আমাদের জন্মের অনেক আগেই আমার দাদা মারা গিয়েছিল।
ওই মহিলার ইচ্ছে গুলো অপূর্ণই থেকে গেল। নিজের স্বামী মারা যাওয়ার পর ননদরা ওনার পছন্দের সমস্ত কাপড় নিয়ে গেল। এটা করা মোটেও ঠিক না। তবে বর্তমান সময়ে বাস্তবতা খুব কঠিন। কারণ যে নিয়মগুলো আগে থেকেই মেনে নেয়া হয়েছিল। সেগুলো মেনে নিতেই হবে। ধন্যবাদ উপরোক্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য। ভালো থাকবেন। আপনার পোস্ট থেকে জানতে পারলাম, মানুষের জীবনটা কতটা অসহায়, আর মেয়েদের বাড়ি বলে সত্যিই কিছু নেই।