বালকবেলার কিছু মজার খেলা
আজকে একটু অন্যরকমের লেখা নিয়ে হাজির হলুম । ছোটবেলায় গ্রামে থাকতে অনেক মজার মজার খেলা খেলতুম । সেই খেলাগুলোর কথা এখনো মনে পড়ে আমার । স্মৃতির কপাট খুলে বসে থাকি একটু নির্জন একাকী সময় পেলেই । আজকে আমার স্মৃতির মণিকোঠায় সযত্নে তুলে রাখা আমার সেই সব মণিমাণিক্য আপনাদের সাথে কিছুটা শেয়ার করতে চাইছি ।
আশা করছি খুব একটা খারাপ লাগবে না ।
ক্রিকেট : আমার সব চাইতে প্রিয় আউটডোর গেম । ছোটবেলায় কত যে ক্রিকেট খেলেছি তার ইয়ত্তা নেই । গ্রামে বর্ষাকালে ক্রিকেট খেলা অসম্ভব ছিল, তাও আমরা বারান্দায় খেলতাম । সব চাইতে বেশি খেলা হতো শীতকালে । বসন্তকালেও মোটামুটি ভালোই খেলা হতো । তবে গ্রীষ্মকালে রোদের তাপ না পড়া অব্দি খেলা শুরু করতে পারতুম না । পুজোর পরে বার্ষিক পরীক্ষার চাপ থাকতো তাই একটু কম খেলা হতো । এরপর দীপাবলির পর থেকে শুরু হতো খেলা । আমি স্পিন বোলিং পারতুম, লেগ স্পিন । তবে ব্যাটিংয়ে ভয়াবহ রকমের খারাপ ছিলুম । যেদিন ১০ রান করতে পারতুম সেদিন নিজেকে শচীন-শেবাগ মনে করতুম ।
ফুটবল : একটু কম খেলা হতো আমাদের গাঁয়ে । ছেলেরা সবাই শচীনভক্ত । রোনাল্দোভক্ত শুধু বিশ্বকাপের সময় । তবু নিয়মিত এটাও খেলা হতো । ফুটবলের ব্লাডার প্রায়ই লিক করতো আমাদের, সল্যুশন দিয়ে লিক সরিয়ে তবে আবার কিক মারতুম । আমি ব্যাক এ খেলতুম । ফুটবল খেলা তেমন একটা প্রিয় ছিল না আমার কাছে । আমাদের ধ্যান জ্ঞান ছিল একমাত্র ক্রিকেটে ।
হকি : শীতকালে হকি খেলার প্রচলন ছিল আমাদের ছেলে-ছোকরাদের মধ্যে । অজ পাড়াগাঁ হকি স্টিক পাবো কোথায় ? তাই নিজেরাই খেঁজুরের ডাল কেটে তা দিয়ে হকি স্টিক তৈরী করে নিতাম । আর বল ? রাবার ডিউস । এগুলো দিয়েই মহা উৎসাহে হকি খেলতাম আমরা । নিয়ম ছিল কারো পায়ে আঘাত করলে সেই প্লেয়ারকে ওই খেলায় বসে যেতে হবে । এই নিয়মের ঠেলায় প্রায়ই দুই দলের অর্ধেক প্লেয়ার বসে যেত । আমি একবার ৩০ টা গোল দিয়েছিলুম । তার কারণ একমাত্র গোলকিপার ছাড়া বিপক্ষ দলের আর সব প্লেয়ার বসে গিয়েছিলো ।
ব্যাডমিন্টন : শীতকালে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল এই খেলাটি আমাদের মাঝে । ক্রিকেট খেলা শেষ করতুম সন্ধ্যের বেশ কিছুটা আগে ভাগেই, এর পরে শুরু হতো আমাদের ব্যাডমিন্টন খেলা । racket, feather (shuttle cock, net এ তিনটি কেনা হয়ে যেত পুজোর সময়েই । শীত পড়ার সাথে সাথেই কোট কাটা সারা । খেলা চলতো সন্ধ্যের বেশ কিছুটা আগে থেকে সন্ধ্যের বেশ খানিকটা পরেও । গা গরম করা খেলা ।
কাবাডি : আমাদের সময়ে ফ্রি হ্যান্ড গেমগুলোর মধ্যে সব চাইতে জনপ্রিয় ছিল এই খেলাটি । আমার মনে হয় এই গেমটি খেলেনি এমন কোনো ছেলে পাওয়া যাবে না আমাদের কমিউনিটিতে । গরমের অলস বিকেলে সন্ধ্যের আগে পুকুরপাড়ে একটি ছায়াময় স্থানে মাটি কিছুটা কুপিয়ে আমরা কাবাডির ছক কাটতাম । এ খেলা ছিল শক্তিমানদের । আমি বেশিক্ষন দম ধরে রাখতে পারতাম । তবে গায়ে কিছুটা পাতলা থাকার কারণে বিপক্ষের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়তাম মাঝে মাঝে । ভারতের অন্যতম জাতীয় খেলা এই কাবাডি, বাংলাদেশে যা হা-ডু-ডু নামে পরিচিত ।
মার্বেল : অসম্ভব প্রিয় একটি খেলা ছিল আমার । টিফিন টাইমে, সকাল বেলা, দুপুর বেলা, বিকেল বেলা, সন্ধ্যে বেলা - কোনো নির্দিষ্ট টাইম ছিল না এই খেলার । পকেটে সব সময় কাঁচের গুলি থাকতো । টাইম পেলেই মার্বেল খেলায় মেতে উঠতুম । অনেক অনেক মজার স্মৃতি আছে মার্বেল নিয়ে আমার । একদিন শেয়ার করবো ।
চোর-পুলিশ : পৃথিবীর প্রায় সব দেশের বাচ্চারা এখনো এই ফ্রি-হ্যান্ড এই গেমটি খেলে থাকে । দুই দলে বিভক্ত হয়ে খেলতে হয় । একদল চোর, আরেক দল পুলিশ । চোরেরা লুকিয়ে থাকে, পুলিশদের খুঁজে বের করে তাদের পাকড়াও করা । খুঁজে সহজে পাওয়া গেলেও ধরা কঠিন ছিল । ভীষণ দৌড়োদৌড়ি আর বুদ্ধির খেলা ছিল এটি । আমার ভীষণই প্রিয় ছিল ।
লুকোচুরি : এটিও সারা পৃথিবী জুড়ে বহুল প্রচলিত এবং জনপ্রিয় খেলা । একজন হতো চোর । সে দৌড়ে একটি গাছের কাছে গিয়ে আমাদের পিছন ফিরে ১ থেকে ৩০ অব্দি জোরে জোরে গুনতে থাকতো, আর আমরা এই অবসরে লুকিয়ে পড়তাম । এরপরে চোরের কাজ ছিল লুকোনো ছেলেদের খুঁজে বের করা । কাউকে এক ঝলক দেখতে পেলেই চিৎকার করে তার নাম ধরে বলতো অমুক মার্ । ব্যাস তার লুকানোর দফা রফা । আর লুকোনো অবস্থাতে যদি কেউ চোরকে বুঝতে না দিয়ে পিছন থেকে ছুঁয়ে দিতো তবে সে সঙ্গে সঙ্গে আবার চোর হয়ে নতুন করে খেলা শুরু হতো । আর তা না হলে প্রথম যাকে দেখতে পেয়েছিলো সেই হতো পরেরবার চোর ।
রাম-শ্যাম-যদু-মধু : এটি একটি ইনডোর গেম ছিল । ১৬ খানা ছোট ছোট সমান মাপের কাগজের টুকরোয় ৪ টে করে কাগজে রাম, শ্যাম, যদু এবং মধু লেখা হতো । এর পরে এগুলো ভালো করে এলোমেলো করে চার জন প্লেয়ার এর মধ্যে না দেখে ডিস্ট্রিবিউট করা হতো । এক জন তার পাশের জনকে এক খানা কাগজ পাস করতে পারতো তার বদলে তার কাছ থেকে আরেক খানা নিয়ে । সবারই টার্গেট থাকতো কে আগে একই নামের চারখানা কাগজ মেলাতে পারে । যে পারতো তারই জিৎ ।
চোর-ডাকাত-পুলিশ : এটাও ছিল ভীষণই মজাদার আরেকটি ইনডোর গেম । চার খানা সমান মাপের কাগজের খন্ডে লেখা হতো পর্যায়ক্রমে "চোর ০০", "ডাকাত ৩০০", "পুলিশ ৫০০" এবং "দারোগা ৮০০" । এরপরে কাগজগুলি রোল করে এলোমেলো করে ছড়িয়ে দেওয়া হতো । প্রত্যেকে এক এক খানা কাগজ তুলে নিতো । যার ভাগ্যে দারোগা উঠতো সে ডাইরেক্ট ৮০০ পয়েন্টস পেয়ে যেত । এবং নিজেকে রিভিল করতো । এবার যার ভাগ্যে পুলিশ উঠতো তাকে নিজেকে পুলিশ ঘোষনা করে বাকি দুই জনের মধ্যে আন্দাজে এক জনকে চোর খুঁজে বের করতে হতো । যদি সাকসেস হতো তাহলে পুলিশ যে পেয়েছে সে ৫০০ পয়েন্টস, ডাকাত ৩০০ পয়েন্টস আর চোর শূন্য পয়েন্টস পেতো । আর যদি পুলিশ চোর ধরতে ব্যর্থ হতো তাহলে পুলিশ পেতো শূন্য পয়েন্টস এবং চোর পেতো পুলিশের পয়েন্টস, অর্থাৎ ৫০০ পয়েন্টস ।
লুডু : লুডুও খেলেছি ছেলেবেলায় বিস্তর । বাড়িতে জেঠতুতো-খুড়তুতো-পিসতুতো বোনেদের সাথে । স্কুলে বান্ধবীদের সাথে টিফিন পিরিয়ডে । পুকুরপাড়ে বিকেলবেলায় সমবয়সী মেয়েদের সাথে । তবে ছেলেদের সাথে এই বস্তুটি খেলা হয়নি কখনো । লুডু শুনেছি মেয়েদের খেলা । তাই তো জীবনেও ওদের সাথে পেরে উঠিনি । ছয় ফেলতে পারতাম না মোটেও । বহু কষ্টে যদি বা ছক্কা পড়তো আমার ঘুঁটি আবার খেয়ে ফেলতো বিপক্ষ । প্যাথেটিক ছিল লুডু খেলার অভিজ্ঞতা । আমার ধারণা মেয়েরা চিটিং করতো, কিন্তু, কৌশলটা কোনোদিনও ধরতে পারিনি ।
ক্যারম : অসম্ভব প্রিয় একটি ইনডোর গেম যেটা এখনো মাঝে মাঝে বাড়িতে খেলি । ছোটবেলায় নেশা ছিলো আমার এই ইনডোর গেমটি । আমার বাবার যৌবনকালের নেশা ছিল তিনটি গেম । তিনটেই মারাত্মক নেশা জাতীয় খেলা - তাস, দাবা আর ক্যারম । বাবার মতো অতো ভালো ক্যারম কোনোদিনও খেলতে পারিনি । এখনো সত্তর বছর বয়সে খেলতে বসলে আমরা গো হারান হেরে যাই ।
তাস : তাস খেলতাম সেই খুব ছোট্টবেলা থেকে । বললে বিশ্বাস করবেন না কিন্তু প্রথম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই তাস খেলা শিখেছিলাম । বাড়িতে ছিল অনেক তাসের প্যাকেট । আমার বাবার ছিল তাসের নেশা । আমার মাত্রারিক্ত তাসের প্রতি আসক্তি দেখে বাবা এই নেশাটি নাকি কাটিয়ে ফেলেছিলো । বড় হয়ে আর কোনোদিনও তাই বাবাকে তাস খেলতে দেখিনি, আমারও তাসের নেশা কেটে গিয়েছিলো ।
দাবা : দাবা আমার রক্তে । কারণ আমার বাবা । অসম্ভব পাকা খেলোয়াড় তিনি । আমিও খুব ছোট্টবেলা থেকে তুখোড় দাবা প্লেয়ার হয়ে উঠেছিলাম । ক্লাস টু তে পড়ার সময়েই ৩০-৪০ বছরের পাকা মাথার দাবা প্লেয়ারদের ধরাশায়ী করেছি । এই একটি মাত্র খেলা যেটা আমি বা আমার বাবা কেউ জীবনেও কাটিয়ে উঠতে পারিনি । আমি এখন কম্পিউটার-এ খেলি । রেকর্ড ধরে রেখেছি, কম্পিউটার পারে না । বিশেষ চেস সফটওয়্যার ছাড়া আমাকে হারানো অসম্ভব । এলেবেলে কম্পিউটার চেস গেমে সব সময়ই জিতি ।
You've got a free upvote from witness fuli.
Peace & Love!