রাক্ষসের ঘরবাড়ি কাহিনী "আমার বাংলা ব্লগ"
মায়ের হাসিতে ঝলকে উঠত অমলতাস চাঁদ: রাজেন্দ্রাণী
তারপর সত্যি সত্যি একদিন মা-কে উদ্ধার করবার সংকল্প নিয়ে আমি রাক্ষস মারতে বেরোলাম।
সে ছিল আমার ছোটবেলা, অনেকানেক নির্জন দুপুরে ঘোষেদের বিরাট দিঘিতে ব্যাংবাজি করবার সময়ে নির্দোষ ভগ্ন প্রাসাদটিকে নিরীহ ধ্যানস্তূপ মনে হলেও রাত্রিবেলা সেটাকেই নির্দয় রহস্যে ভরে ওঠা প্রেতপুরী ভাবাত যে বয়েস। আমার বাবা ছিল সেই প্রাসাদের কেয়ারটেকার, আগাছা ভরা বিশাল বাগান, জঙ্গুলে অন্ধকারের হিম চোখ আর অসংস্কৃত দীঘির গম্ভীর কুচকুচে জলকে কোনওরকম পরিমার্জন করবার দায় না নিয়েও যে বৃত্তিতে নিয়মিত মাসমাইনেটুকু জুটেই যেত, বুড়ো রাগেন্দ্রনারায়ণ ঘোষের সৌজন্যে। তিনি ছিলেন এই প্রাসাদের একমাত্র জীবিত প্রতিনিধি, তাঁর প্রচণ্ড ভয়াল ছয়ফুটের অবয়বে আহ্লাদ-ভগ্ন কণ্ঠস্বরের জায়গা ছিল না। তাঁর দেখার মধ্যে ছিল একটা পাকানো গোঁফ, আর রগচটা মেজাজ। শোনা যায়, পাটনাতে চাকুরিরতকালে একবার এই চণ্ডরাগের বশবর্তী হয়ে অধীনস্থ একটি গরীব দেহাতি ভৃত্যকে তিনি গুলি করে মেরে দিয়েছিলেন। ওপরতলার হস্তক্ষেপে সে কেস ধামাচাপা পড়লেও চাকরিটি বাঁচেনি। তারপর তিনি এখানে চলে আসেন এবং রুগ্ন কাহিল জন্তুর মতো পূর্বপুরুষের প্রাসাদ শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগের কয়েকটা ধুকপুক মুহূর্তে তাঁকে গিলে খেয়ে নিয়েছিল। তিনি বাড়ি থেকে বেরতেন না খুব একটা, তবে না বেরলেও তাঁর চণ্ডালের মত ক্রোধ প্রসিদ্ধ ছিল এ অঞ্চলে। আশেপাশের ছেলেরা বুড়োকে ‘রাগবাবু’ বলে ডাকত। বড় হবার মর্মন্তুদ এক মুহূর্তে বুঝেছি, তিনি অতটা বুড়োও ছিলেন না।
এরকম এক বাড়িতে কেয়ারটেকার হয়ে দৈনন্দিন বাজার, ব্যাঙ্ক, টুকটাক করতে করতেই আমার বাবা বয়ে ও ক্ষয়ে গেল, কিন্তু ঘোষবাবুর জন্য সারাদিন রান্না করবার পরেও মায়ের হাসিতে ঝলকে উঠত অমলতাস চাঁদ। মায়ের বিশাল চুল ধরে আমি তখন ঝুলতাম, তার ভরাট চোখের ভেতর খুঁজে নিতাম নিজস্ব পুকুর। বস্তুত, মায়ের চওড়া কাঁধ, পিঠ আর কোমরছাপানো গভীর চুল ছিল আমার ক্রীড়াভূমি, আর মা-ও সারাদিন কাজের পর একবিন্দু বিরক্ত না হয়ে সেই প্রতিটা সন্ধ্যা আমার সঙ্গে খেলেছিল, একসঙ্গে খুঁজেছিল হিমেল মাটির ভেতর জমে যাওয়া আশ্চর্য বাদাম, দীঘির জলে ব্যাংবাজি করেছিল পাল্লা দিয়ে, বাগানের ভেতর আলুখ শালুখ কুড়িয়ে গিয়েছিল অনাদৃত কচি আম ও ঝরা পাখির বাসা। বাবা আমাদের ঘরের ভেতর মৃদু বাল্বের আলোতে শুয়ে থাকত তখন, আর বিদ্বেষভরা চোখে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে যেত, ‘নষ্ট মেয়েমানুষ! নষ্ট গর্ভ!’
Good