আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর এক রাতের গল্প।
কেমন আছেন "আমার বাংলা ব্লগ" পরিবারের সবাই । আশা করি আপনারা সবাই মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় খুব ভালো আছেন। আর আমার মুসলিম ভাই-বোনদের জানাই অগ্রিম ঈদের শুভেচ্ছা।

সোর্চ
আজ আমি আপনাদের সাথে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এক ভয়ঙ্কর রাতের গল্প শোনাবো। আর এই গল্পের কোন অংশই কাল্পনিক নয়।
তখন আমার বয়স ১২ কিংবা ১৩। তখন আমি মা বাবার সাথে আমাদের গ্রামেই বসবাস করতাম। তখন আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। সেই সময়টা ছিল আমাদের বাঙ্গালীদের কালীপুজোর সময়। আমাদের গ্রাম থেকে বাজারের দূরত্ব প্রায় আট-নয় কিলোমিটার। গ্রাম থেকে বাজারে যাওয়ার রাস্তা ছিল মাটির কাঁচা রাস্তা। আর বর্ষাকালে ওই রাস্তায় হাঁটু সমান কাদায় ভরে যেত।
আমরা সবাই জানি যে, এই কালীপুজো অমাবস্যার রাতে হয়। প্রায় প্রতি বছরই আমাদের এই ছোট্ট বাজারটিতে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান হত এই কালীপুজোর সময়।
অন্যান্য বারের ন্যায় এবারও আমাদের এই ছোট্ট বাজারটিতে একটা গানের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। তো আমরা খুবই উৎসাহী ছিলাম এই অনুষ্ঠান দেখার জন্য। কলকাতা থেকে বিভিন্ন বড় বড় শিল্পীরা এই অনুষ্ঠানে এসে গান পরিবেশন করত। বিভিন্ন গ্রাম থেকে বহু লোক এই অনুষ্ঠান দেখার জন্য বাজারে এসে ভিড় জমাত।
আমাদের গ্রামের কয়েকজন বড় দাদা মিলে ঠিক করলো যে, এই অনুষ্ঠান আমরা সবাই একসাথে দেখতে যাব। সুতরাং তাদের প্লান অনুযায়ী আমরা সবাই ঐদিন রাতে একসাথে ওই অনুষ্ঠান দেখতে গেলাম। সবার ভিতর আমি ছিলাম ছোট সদস্য। সবার হাতে বাজারে যাওয়ার জন্য টর্চলাইট ছিল। কিন্তু আমার হাতে কোন টর্চ লাইট ছিলনা। আমি ভেবেছিলাম যে, সবার হাতেই টর্চ লাইট রয়েছে সুতরাং আমার টর্চলাইট নেওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না।
আমাদের ওই বাজারে হেঁটে যেতে প্রায় ৪০ মিনিট সময় লেগেছিল। বাজারে গিয়ে দেখি বহু লোকের সমাগম হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের দোকানও বসেছে।
একটা দোকান থেকে আমি কিছু বাদাম কিনে ওই অনুষ্ঠানের মাঠে প্রবেশ করলাম। আমাদের টার্গেট ছিল অনুষ্ঠান মঞ্চের ঠিক সামনের আসন দখল করা। তাই আমরা অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার অনেক আগেই চলে এসেছিলাম। আমরা প্রায় রাত সাড়ে বারোটা অব্দি ওই অনুষ্ঠান দেখলাম। শেষের দিকটাতে মানুষের সংখ্যা অনেকটাই কমে গিয়েছিল।
কিছুক্ষণ পর দাদারা আমায় বলল, তুই এই জায়গাতেই বসে থাক । আমরা একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসছি। আমি অনেকক্ষণ ধরে তাদের আসার অপেক্ষায় রইলাম। কিছুক্ষণ পর অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। সবাই সবার মত বাড়ির দিকে রওনা হল। কিন্তু আমি দাদাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
আস্তে আস্তে মাঠ প্রায় জনশূন্য হয়ে গেল। তখন আমি দাদাদের খুঁজতে আরম্ভ করলাম। দাদাদের খুঁজে না পেয়ে আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। তখন আমি কি করবো ভেবে উঠতে না পেরে বাড়ির দিকে রওনা করলাম।
আমার কাছে কোন লাইট না থাকার কারণে আমি খুব বিপদে পড়লাম। ও আরেকটা কথা আমাদের ওই গ্রামের রাস্তায় কোন রোড লাইট ছিল না। বাজারের কাছের কিছুটা পথ দুই একজন লোককে দেখতে পেলাম। যতই হাঁটছি ততই লোক কমে যাচ্ছে। আর আমরা সবাই জানি যে অমাবস্যার রাত খুবই অন্ধকার হয়। ওই রাতে আশেপাশের কোন কিছুই দেখা যায় না।
এক সময় রাস্তা পুরোপুরিই জনশূন্য হয়ে পড়ল। তখন আমার ভয় আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো। আরো একটা কথা গ্রামের ওই মাটির রাস্তা দুপাশে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা থাকার কারণে রাস্তা আরো বেশি ভয়ংকর লাগছিল।
আমাদের বাড়িতে যেতে হলে একটা মাঠের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। ওই মাঠের দু'পাশে অনেক বড় বড় ফাঁকা জমি। ফাঁকা জমির মাঝে মাঝে কয়েকটা তালগাছ, কয়েকটা ছোট ছোট বাগানো রয়েছে।
কিছুদিন আগে আমাদের পাশের গ্রামের এক ক্যান্সার আক্রান্ত লোক তার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একটা গাছে গলায় দড়ি দিয়ে মারা গিয়েছিল। ওই গাছটি এই মাঠের ভিতরেই ছিল। আমিও দেখতে গিয়েছিলাম ওই লোকটিকে। তো উনার কথা মনে পড়ে আমার ভয় আরো একশ গুণ বেড়ে গেল। আমি কি করবো ভেবে উঠতে পারছিলাম না। আমার মাথা ঠিক থাক কাজ করছিল না। আমার কোন পরিচিত লোকও নেই যে তাদের বাড়িতে আমি ওই রাতটুকু কাটিয়ে যাব।
তখনকার সময় মোবাইলেরও তেমন ব্যবস্থা ছিল না। তো আমি সামনে পিছনে না ভেবে জোর পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম।
মাঠে প্রবেশ করার কিছু মুহূর্তে রাস্তার পাশে একটা বড় বাঁশ বাগানও ছিল। ওই বাঁশতলা নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার খুব ভয় লাগছিল। আমি তখন জোরে জোরে গান গাইতে শুরু করলাম। কি যে গান গাইছিলাম তা আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম না।
বাঁশবাগান পার করে আর কিছুক্ষণ পর আমি একদম প্রায় মাঠের মাঝখানের রাস্তায় চলে এলাম। তখন আবার আবারও ওই ক্যান্সার আক্রান্ত লোকটির কথা মনে পড়ে গেল। কারণ ওই মাঠের মাঝখানে তিনি যে গাছটিতে গলায় দড়ি দিয়েছিলেন সেই গাছটি এই রাস্তা থেকে দেখা যায়। তো আমি কি করবো? আমার মাথা তখন পুরোপুরি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল।
আবার রাস্তার পাশে কয়েকটা বড় বড় তাল গাছও ছিল। তাল গাছের পাশ দিয়ে যাবার সময় আমার মাথার চুল খাড়া হয়ে যাচ্ছিলো। ওই সময় আমার পিছন দিকে কোন একটা আওয়াজ আমি শুনতে পেলেই সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যেতাম।
আর কিছুক্ষণ পরেই আমাদের পাশের গ্রামে এসে আমি পৌছালাম। তখন মনে একটু সাহস সঞ্চয় হলো। ওই গ্রাম থেকে আমাদের গ্রামে যেতে প্রায় ১০ মিনিট সময় লাগে।
এর মাঝে আরেকটি ভয়ের জায়গা আছে। সেটি হলো গাব গাছের বাগান। ছোটবেলায় ঠাকুরমা বলতো, দুপুরবেলা কখনো গাব বাগানে যাবিনা। কারণ গাব বাগানে নাকি দুপুরবেলা ভূত-পেত থাকে।
তো কিছুক্ষণ পর আমি ওই গাব বাগানের পাশে এসে পৌছালাম। তখন আমার ভয় এতটাই বেড়ে গেল যে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। তখনই আমি দৌড় শুরু করলাম। এক দৌড়ে আমি বাড়িতে গিয়ে পৌছালাম।
আমি প্রায় সাত মিনিট দৌড়েছিলাম। বাড়ির সামনে এসে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। ঘর থেকে মা দৌড়ে এসে আমাকে ধরে চিৎকার শুরু করল। তখন ঘর থেকে বাবা এসে আমায় তুলে ঘরে নিয়ে গেল এবং আমার মাথায় জল ঢালল। এরপরে আমার আর কিছুই মনে ছিল না। কারণ সারা রাতে আমার আর জ্ঞান ফেরেনি।
পরের দিন সকালে আমার জ্ঞান ফিরে আমি দেখি, আমি খাটে শোয়া আর আমার হাতে স্যালাইন দেওয়া ছিল। তো কিছুক্ষণ পর মা আমাকে আগের দিনের সব ঘটনা জানতে চাইলেন। আমি সব ঘটনা তাদের খুলে বললাম। আমার মা খুব রাগারাগি করলেন এবং ওই বড় দাদাদেরও খুব বকলেন। তখন দাদারা মাকে বলল, কাল ওরা এত মানুষের ভিড়ে আমাকে নাকি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
যাই হোক এর পরের কিছুদিন আমাকে আর মা-বাবা বাইরে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খেলতে যেতে দিলেন না। এরপর থেকেই আস্তে আস্তে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে আমি আবার আগের ন্যায় মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলতে শুরু করলাম।
এটাই ছিল আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এক ভয়ংকর রাত। যে রাতের কথা আমি এখনো ভুলতে পারিনি।
আজ এই পর্যন্ত। দেখা হবে পরবর্তী পোস্টে। ততক্ষণ সবাই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন।
Your post has been rewarded by the Seven Team.
Support partner witnesses
We are the hope!
একটা কথা আছে মনের ভয়ই বড় ভয়। যেটা ঐরাতে আপনার সঙ্গে হয়েছিল। এবং গ্রামের চ মেঠোপথে যে রোডলাইট থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। এবং আপনার ঐ দাদারা কাজটা মোটেই ঠিক করেনি। আপনার আরও বড় কিছুও হতে পারত। তবে এখানে শিক্ষনীয় অনেক বিষয় আছে। বেশ ভালো লাগল দাদা আপনার ছোটবেলার এই ঘটনা টা শুনে।