সহযাত্রী || 10% beneficiary @shy-fox
ব্যস্ত নগরীর অন্যতম ব্যস্ত বাস স্টপে রাত তখন প্রায় ৮ঃ৩০ টা। যাত্রী সংখ্যাও অসংখ্য। এত যাত্রীর ভিড়ে হয়ত আলাদা করে চোখে পরেনা এমন দুইজন যুবক-যুবতী আমার আজকের উপাখ্যানের মূল চরিত্র।
তাদের বর্ণনা দেবার বিশেষ কিছু নেই। তবে টিংটিঙে তরুণীর ফোন থেকে শুরু করে বিশাল এক ব্যাগ টানতে গিয়ে স্বাস্থ্যবান তরুনটির অবস্থা তখন নাজেহাল- এই টুকু বেশ বোঝা যাচ্ছিল। অন্যদিকে সেই তরুণী ঝাড়া হাত পায়ে তার হাত ধরে আছে। এইটুকু পড়ে অনেকের কাছে মনে হতে পারে এ বুঝি বৈষম্য হচ্ছে। কিন্তু ১০ গজ দূরের লেনের এক ভ্রাম্যমান দোকানের মালিক এই বৈষম্যরূপী প্রেমই দেখে আসছে গত ২ বছর ধরে।
ওঃ বলে রাখা ভাল, তরুণ-তরুণীর গন্তব্য আলাদা। রাতও বেশ হয়েছে তাই এখন বাসে না উঠে উপায় নেই। বলা বাহুল্য তারা এখন তরুণিটির বাসের জন্যই অপেক্ষা করছে। বাসও আসছে যাচ্ছে। কিন্তু বাসে ভিড়। তাই উঠা আর হচ্ছিল না কিছুতেই।
হঠাৎই একটা বাস আসলো যাতে একটামাত্র সিট ফাঁকা দেখা গেল। সেটা দেখেই তরুণীটি কোনরকম বাছ-বিচার না করে বাসে উঠে পরল। কিন্তু তরুণটির হাত থেকে তার ব্যাগ এবং ফোন নিতে নিতে সে সিটের কাছে পৌঁছাতে দেরি করে ফেলল। এবং সে যে নেমে পরবে সেই সুযোগকে সম্পুর্ণ বন্ধ করে দিতেই যেন হুড়মুড় করে অনেকগুলো যাত্রী উঠে পড়ল। অগত্যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তার যাত্রা শুরু হল। তরুণটি কিন্তু এসবের কিছুই জানলো না।
বাসে সব সময় পুরুষ যাত্রীই বেশি থাকে। আজকেও তাই। সে বাদে আর মাত্র দুইজন নারী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুদূর যেতে না যেতেই সে আবিষ্কার করল যে সে ছাড়া অন্য কোন নারী দাঁড়িয়ে নেই। তখন আমাদের তরুণীটি খুব করুণভাবে বাসের অদ্যপ্রান্তে তাকালো। তার কাঁধে ১০ কেজি ওজনের একটা ব্যাগ দেখেও তাকে জায়গা না দিয়ে বাকি দুইজনকে জায়গা দেওয়ায় যেন মনে খুব দুঃখ পেয়েছে। সেই ব্যাপারটিই যেন লক্ষ করল তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়সী একজন মানুষ।
তাকে কিছু বলা হয়নি, কিন্তু সে নিজেই আশে পাশের সিটে বসে থাকা সবাইকে জিজ্ঞেস করছে কে কোথায় নামবে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সে তরুনীটির জন্য একটা সিট বুক দিয়ে ফেলল। কি আশ্চর্যরকম ভাল এই লোকটা! তাই বুঝি পরবর্তী স্টপে সে নিজেও একটা সিট পেয়ে গেল। বোধ করি সব কৃতজ্ঞতা ধন্যবাদ দিয়ে প্রকাশ করা যায়না। কিন্তু তরুণীটির প্রশান্তিমাখা হাসি নিশ্চয় তাকেও প্রশান্ত করবে।
সময় গড়িয়ে চলছে। বাসও গড়িয়ে চলছে। আর চলতে চলতে এমন জায়গায় থামল যেখান থেকে এক মা তার বছর পাঁচেকের একটা ছেলেকে নিয়ে বাসে উঠলো। তখনো বাসে গাদাগাদি লোক। তাই বসার জায়গা পাবার কথা ভাবাও যায়না। মা-টি তার ছেলেকে নিয়ে তরুণিটির পাশে এসেই দাঁড়ালো। বাসে ঝাকুনিতে মা নিজেই দাঁড়াতে পারছে না, তাই তার পক্ষে ছেলেকে ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব।
তখন তরুণীটি হাসিমুখে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল, "কোলে বসবে?"
বাচ্চা ছেলেটা দেখল এই মেয়েটির কোলে বিশাল এক ব্যাগ, তার বসার জায়গা কই? তাই সেইটুকুন ছেলে হাসিমুখেই উত্তর করল, "না, বসব না।"
কিন্তু তরুনীটি দেখল বাচ্চাটা আসলেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তাই সে এক হাঁটুর ওপরে সেই ১০কেজি ব্যাগ রেখে অন্য হাটুতে বাচ্চাটাকে বসালো। এইবার তার মা ভালোমতো দাঁড়ানোর সুযোগ পেল এবং ক্ষণে ক্ষণে তরুণিটিকে ধন্যবাদ দিচ্ছিল। আর তরুণীটি তার শ্রেষ্ঠ হাসি দিয়ে সেই ধন্যবাদগুলো গ্রহণ করছিল।
এভাবে বেশ কিছু সময় কেটে যাবার পর মা-টি বসায় জায়গা পায়। বাচ্চাটি তার মায়ের কাছে যাবে। ঠিক সেই সময়ে তরুণীটি ব্যাগ খুলে একটা চকলেট দিল তাকে। কি ভদ্র বাচ্চা! মায়ের অনুমতি না পেলে সে কিছুতেই সেটা নিবে না। অগত্যা তার মায়ের অনুমতি নিতে হল।
প্রায় ৩০ মিনিট এক সাথে ভ্রমণ করার পর বাচ্চাসহ মা-টি নেমে গেল। আর ক্ষণিকের জন্য যখন তরুনিটি তাদের দিকে তাকালো তখনো ধন্যবাদ দিতে ভুলে গেল না।
কে বলেছে পৃথিবীতে ভালো মানুষ নেই? আমাদের শুধু এগিয়ে আসতে হবে এবং সাহায্য পাবার আগে অন্যদের সাহায্য করতে হবে। তাহলেই সবার মধ্যে সাহায্য করার বোধটি জেগে উঠবে। আর এইভাবে সেই মধ্যবয়সী লোকটির কল্যাণে তরুণীটি একদিনে দুটো ভালো মানুষের পরিচয় পেল।
কথায় আছে নিজে ভালো তো জগৎ ভালো। প্রত্যেকটা খারাপ মানুষের মধ্যেও একটা ভালো মানুষ বাস করে। সেই ডাক্তার জেকিল এবং মি. হাইডের মত। আমাদের কাজ শুধু ডাক্তার জেকিল কে নার্চার করা। অভিজ্ঞতা টা কার জানতে ইচ্ছে করছে।