সিন্ধুদেশের রাজা জয়দ্রথ শেষ পর্ব

in আমার বাংলা ব্লগ10 days ago

প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,


সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।


Messenger_creation_1307695530306886.jpeg

[সোর্স](মেটা AI)








আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।



মহাভারতের মহা-নির্মাণ (জয়দ্রথ)
------------------------------------------------------ নীলম সামন্ত

যখন বারবার করে বলছেন যে তিনি একবার ভালো করে দেখতে চান তখনই বোঝা যায় এ কোন মুগ্ধতা বা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ নয়। এক ধরনের মানসিক বিকার । এই বিকারগ্রস্ত মানুষই চারপাশে ছেয়ে গেছেন৷ যে কারণে সমাজ আজ ধুঁকছে।

বিকারগ্রস্ত বলছি কারণ কোটিকাস্য'র থেকে শোনার পরেও তিনি যখন দ্রৌপদীর পর্ন কুটিরে পৌঁছলেন তখন একেবারেই না জানার ভান করে গেলেন। পরিচয় পর্ব শেষে দ্রৌপদী ও বুঝলেন যে ইনি তার পারিবারিক আত্মীয় বটে। তবে আত্মীয় হবার সম্মান জয়দ্রথ রাখতে পারেনি বেশিক্ষণ। সরাসরি শারীরিক প্রস্তাব দেন এবং বিবাহের কথা বলেন। দ্রৌপদী যেহেতু ভুক্তভোগী তাই সরাসরি চিৎকার করাই তার কাছে সহজ উপায় ছিল বাঁচার। চিৎকার শুনে তার পাঁচ স্বামী তৎপর হয়ে ফিরে আসছে আর জয়দ্রথও বেগতিক দেখে পালিয়ে যেতে উদ্ধত হলেন। সামান্য দূরেই ভীমের হাতে ধরা পড়ার কারণে তার পালানোর চিন্তাভাবনা বানচাল হয়ে গেল। ভীম হয়তো তাকে সেই জায়গায় মেরেই ফেলত কিন্তু জয়দ্রথের পূর্ণ পরিচয় পাওয়ার পর, যুধিষ্ঠির ক্ষমার চোখে দেখলেন এবং দাসত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য হওয়ার থেকে মুক্তি দিলেন৷

দুষ্টের দমন যেন সহজে হয় না। এই লোলুপ পুরুষ যেমন মেয়েদের চারপাশে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করে তেমনি কিছু মানুষ এমনও আছে যারা রক্ষা করার জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তবে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় পৌঁছতে পারে কি? জয়দ্রথের ক্ষেত্রে তা ঘটেছিল। আজকের দিনে আর ঘটে না।

মনের কামনা পূর্ণ না হওয়াও এক ধরনের পরাজয়। কাম্যক বনে যেভাবে জয়দ্রথ যুধিষ্ঠিরের কাছে ক্ষমা লাভ করেছিলেন এবং বাকি পাণ্ডবদের সামনেও মাথা হেঁট করে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন তা আর যাই হোক একেবারেই সুখকর নয়। দুঃখ থেকেও বড় কথা পৌরুষের আঘাত। এ তো আর দেশে পুরুষ নয়, রাজা ধৃতরাষ্ট্রের একমাত্র জামাতা, সিন্ধু প্রদেশের রাজার পৌরুষ। মুখে কিছু না বললেও সবার সামনে চরম অপমান তাঁকে বিদ্ধ করেছিল। এমত অবস্থায় পঞ্চপান্ডবের পরাজয় ছাড়া আর কিই বা চাওয়ার থাকে। তিনি আর যাই হোক মহানুভবতার শিরোমণি যে নন তার পরিচয় আগেই পাওয়া গেছে। পরাজয় মুখের কথা নয়, যে কাউকেই পরাজিত করতে হলে নিজেকে অনেক বেশি শক্তিশালী করতে হয়। এবং সেই উদ্দেশ্যেই জয়দ্রথ গঙ্গার তীরে পৌঁছেছিলেন। তপস্যা করে দেবাদিদেব শিবকে তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন। তা পেরেও ছিলেন। শিব যখন তাঁকে বরদান করতে উৎসাহ দেখালেন, নিজের সুপ্ত বাসনা মেটানোর লোভ না প্রকাশ করে থাকতে পারলেন না, চেয়ে বসলেন পঞ্চপাণ্ডবকে হারানোর বর বলা ভালো, হত্যা করার বর৷ কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব। পঞ্চপান্ডব হাতের পাঁচ আঙ্গুল। যেভাবে তারা জোটবদ্ধ হয়ে জীবন কাটায় একে অপরের শক্তিবর্ধক হিসেবে বাঁচে সেখানে তাদের হারানো প্রায় অসম্ভব। জয়দ্রথের পক্ষে তো আরোই সম্ভব নয়। মহাদেব এও বলেছিলেন তিনি কোনভাবেই অর্জুনকে পরাভূত করতে সক্ষম হবেন না৷ কিন্তু তাপস্যায় তুষ্ট শিব কোনভাবেই জয়দ্রথকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে পারেন না। তাই আশীর্বাদ স্বরূপ তিনি বললেন যেকোনো একদিন জয়দ্রথ অর্জুন ব্যতীত বাকি চার পাণ্ডব কে যুদ্ধে আটকাতে পারবেন। কিন্তু হত্যা করা সম্ভব নয়। কিভাবেই বা সম্ভব হত? পঞ্চপান্ডব কে যদি জয়দ্রথর মতো একজন হত্যা করে দিতে পারে তাহলে কি তাদের হাত ধরে ধর্মের প্রতিষ্ঠা সম্ভব? তবে তো মহাকাব্যের মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ ধর্ম ও ধর্মের সম্পর্কে উচিত পথ দেখানোই অসম্ভব হয়ে যাবে৷

মহাদেবের দেওয়া এই বরের প্রয়োগ করে ঠোঁটে চওড়া হাসি আঁকতে পেরেছিলেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ত্রয়োদশতম দিনে। যেদিন অভিমুন্য বধ হল। অর্জুনের অনুপস্থিতির কারণে একপ্রকার বাধ্য হয়েই চক্রব্যূহ ভেদ করার জন্য অভিমুন্য কে প্রথম সারিতে রেখেছিলেন পান্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির। তবে শর্ত ছিল সঙ্গে চারজনই থাকবেন। চক্রব্যূহর প্রথম দরজা ভেঙে ঢোকার পর যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে গেল অভিমন্যু। সে বীর তার তো থেমে যাওয়ার কথা নয়, কিন্তু থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল চার পান্ডবকে। কে থামিয়ে ছিলেন? সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ। এই একদিন তিনি পরাস্ত করতে পেরেছিলেন অর্জুন ব্যতীত চার পাণ্ডবকে। শিবের বর কার্যকরী হয়েছিল। ফলে অভিমন্যু একা হয়ে যায় এবং বাকি ঘটনা তো সকলেরই জানা। বিখ্যাত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পরিকল্পনা যে শুধুমাত্র কৃষ্ণ করেছিলেন পাণ্ডবদের জন্য তা কিন্তু নয়, কৌরব পক্ষে শকুনিও কম যান না তা এই ঘটনায় স্পষ্টই বোঝা যায়। যথাযথ ভাবে জয়দ্রথ কাজে এলো সাথে পান্ডবদের এক শক্তিশালী ঘুঁটিও বধ হল।

জয়দ্রথর দূরদর্শিতা যে কোন কালেই ছিল না বা সে সুপুরুষ হতে যে কোনোদিনও চাননি তা আবারোও প্রমাণিত হলো। মাথায় নূন্যতম বুদ্ধি ও বিবেচনা বোধ থাকলে এ কাজ তিনি করতেন না। ফুলের মত নরম সুন্দর অথচ পরাক্রমী বীর বালক অভিমুন্য এইভাবে বধ হওয়ার পর যোদ্ধা অর্জুন কি বলবেন তার থেকেও বড় পিতা অর্জুন কি তাকে ছেড়ে দেবেন? নাকি অর্জুন এতটাই দুর্বল যে জয়দ্রথকে বধ করার ক্ষমতা রাখেন না। রাগে দুঃখে পুত্রশোকের আগুনে পুড়তে পুড়তে অর্জুন জয়দ্রথর বেঁচে থাকায় সীমা টেনে ঘোষণা করেছিলেন আর মাত্র একদিন৷ হয় জয়দ্রথ বধ হবে নয় অর্জুন আগুনে পুড়বে৷

এদিকে জয়দ্রথর জন্মের সময় দৈববাণী ছিল বীরযোদ্ধা হলেও যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর হাতে বধ হবেন। জয়দ্রথর পিতা বৃদ্ধক্ষেত্র অনেক সাধনার পর পুত্র লাভ করেছিলেন, পুত্রস্নেহ তাঁর অধিক হবে এই স্বাভাবিক আচরণ। তিনি কোন কিছুই না ভেবে সবার সামনে অভিশাপ দিয়েছিলেন 'তস্যাপি শতধা মূর্ধা ফলিষ্যতি ন সংশয়ঃ' - অর্থাৎ যে মাথা কেটে ফেলবে তার মাথা উঁচির হয়ে যাবে। —

সেদিন যুদ্ধক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এইসব কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। সারাদিন কৌরবদের বড় বড় যোদ্ধারা যখন জয়দ্রথকে ঘিরে থাকলো আশ্রয় দিল, তারপরেও শ্রীকৃষ্ণের বুদ্ধির কাছে হেরে জয়দ্রথ অর্জুনের সামনে এসে দাঁড়ালো, এক শক্তিশালী দিব্যাস্ত্র ছুঁড়ে মস্তক ছেদন করলেন তিনি। শুধু তাই নয় মাথা গিয়ে পড়ল সমন্তপঞ্চকের বাইরে বসে তপস্যারত পিতা বৃদ্ধক্ষেত্রের কোলে। পিতা পুত্র দু'জনেরই ইতি ঘটল।

এইটুকু বুদ্ধি ব্যয় না করলে সেদিন জয়দ্রথের সাথে অর্জুন মারা যেতে পারত। আবার অভিমন্যু বধ না হলে হস্তিনাপুর রাজবংশের জামাতা জয়দ্রথকে বধ করার জন্য অর্জুনও সংকল্পবদ্ধ হতে পারতেন না৷ সবই যেন খাপে খাপে বসানো। জয়দ্রথ ওই একদিনের যুদ্ধের কারণেই বীরযোদ্ধা হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন কৌরব ইতিহাসে৷ যেন দুষ্টের বন্ধু দুষ্ট। তবে আমার মতে জয়দ্রথ বধ মহাভারতের পাতায় সুবর্ণখচিত না হলেও চলে। কারণ জয়দ্রথকে আমরা কোথাও কোনভাবেই পঞ্চপাণ্ডবদের তুলনায় বীর হিসেবে দেখিনি৷ ওই একদিনেএ পরাজয় করতে পারার বর ছাড়া তাঁর হাতে আসলেই কোন ট্রাম্প কার্ড ছিল না৷ আর এই ট্রাম্পকার্ড যে তারই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে সে বিবেচনা করার ক্ষমতাও বোধকরি ছিল না৷ অবশ্যই ছিল না৷ বিপথগামী মানুষেরা আর যাইহোক সুবুদ্ধিসম্পন্ন কখনই নই।

তবে যেই বোনের কারণে জয়দ্রথর বধ কম্যকবনে না ঘটে , কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ঘটার পর প্রমাণ হয়ে যায় যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষের ছায়ার দুটি সম্পর্ক জায়গা দখল করে, শত্রু ও মিত্র৷ তাই জয়দ্রথ ভগিনীপতি হলেও কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে সে কেবল শত্রুপক্ষ ও অভিমন্যু বধের কয়েক মাথার এক মাথা হিসেবেই গন্য হয়েছে। সেখানে কোন ভাতৃস্নেহের ছাতায় কেউ দাঁড়ায়নি। কৌরবরা তো নয়ই পান্ডবরাও নয়। জীবন আর রণভূমির মধ্যে যে বিশাল ফারাক তা জয়দ্রথ বধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। তবে এই দাবী শুধু পান্ডব পক্ষের মাথায় বসালে চলে না৷ কৌরব পক্ষও সম দোষে দুষ্ট। তফাৎ কেবল উদ্দেশ্যে। কেউ ধর্মের জন্য লড়েছে আবার কেউ অধর্মের জন্য৷

1000205476.png


1000216462.png

পোস্টের ধরণজেনারেল রাইটিং
ছবিওয়ালানীলম সামন্ত
মাধ্যমমেটা এ আই
লোকেশনপুণে,মহারাষ্ট্র
ব্যবহৃত অ্যাপক্যানভা, অনুলিপি


1000216466.jpg


১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে


1000192865.png


~লেখক পরিচিতি~

1000162998.jpg

আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।

🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾


1000205458.png

C3TZR1g81UNaPs7vzNXHueW5ZM76DSHWEY7onmfLxcK2iQHKgX7itFyjwbsWanwCxVcpznVPoq74AD9choMCjeWYrTCNC9tGGPVurQJpuwtKhZHHZy98cbp.png

C3TZR1g81UNaPs7vzNXHueW5ZM76DSHWEY7onmfLxcK2iQWqhxxsnyoVYgy5NrLetuJsNGL7qNkULJzJnsWirFd4h3YfksobeNxa5RExcnMgKbhJME1FNai.png

1000205505.png

Coin Marketplace

STEEM 0.11
TRX 0.23
JST 0.030
BTC 78486.21
ETH 1532.09
USDT 1.00
SBD 0.64