সিন্ধুদেশের রাজা জয়দ্রথ পর্ব-২

in আমার বাংলা ব্লগ16 days ago

প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,


সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।


Messenger_creation_1307695530306886.jpeg

[সোর্স](মেটা AI)








আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।



মহাভারতের মহা-নির্মাণ (জয়দ্রথ)
------------------------------------------------------ নীলম সামন্ত

পাঞ্চাল কন্যা দ্রৌপদীর যখন স্বয়ংবর সভা হয় তখন তিনি সেখানেও উপস্থিত ছিলেন। দ্রুপদ কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন এক এক করে সমস্ত রাজার পরিচয় যখন দ্রৌপদীর সামনে তুলে ধরছিলেন তখনই জয়দ্রথ কে উদ্দেশ্য করে উচ্চারণ করেছিলেন 'ভগীরথো বৃহৎক্ষত্রঃ সৈন্ধবশ্চ জয়দ্রথঃ'। যেখানে আমরা প্রথম জানতে পারি জয়দ্রথ সিন্ধু প্রদেশের রাজা। তবে অন্যান্য রাজাদের মতো তাঁকে ধনুক তুলে মাছের চোখ ভেদ করার চেষ্টা কিংবা অপচেষ্টা কোনটাই করতে দেখা যায় না। আবার দ্রৌপদীর মতো তৎকালীন ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরীর প্রতি তার চেয়ে একেবারেই কামনা ছিল না তা অনস্বীকার্য। তবে তিনি কেন এসেছিলেন? নিছকিই সমস্ত রাজা-রাজড়ারা আসছে তাই আসা নাকি স্বয়ংবর সভার বিচিত্র ঘটনার সাক্ষী হিসেবে নিজের নাম লিখিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে?

দ্রৌপদীর প্রতি যে তার কামুক নজর ছিল তা পরবর্তীকালে কাম্যক বনে প্রকাশ পায়। পঞ্চপান্ডবদের তখন বনবাস চলছে। তারা দ্বৈতবন ছেড়ে কাম্যক বনে এসে বসবাস করছেন। এই সময় তাদের সঙ্গে বয়ঃজ্যেষ্ঠ বলতে ছিলেন তাদের কুলপুরোহিত ধৌম্য এবং মহর্ষি তৃণবিন্দু। তৃণবিন্দু ছিলেন আগন্তুক ঋষি। আসলে বনবাসের দিনগুলোতে নানান মুনি ঋষিরা এসে পঞ্চপান্ডবের সাথে বসবাস করতেন। তাদের মধ্যে কেউ থেকে যেতেন আবার কেউ চলেও যেতেন। তবে রাজবাড়ীতে যেভাবে অতিথি আপ্যায়ন করা হয় সেই সমস্ত অত্যাবশ্যকীয় আড়ম্বর সামান্য পর্ণকুটিরে ছিল না। কিন্তু যুগে যুগে অতিথি নারায়ণ। তাই অতিথি সেবার উদ্দেশ্যেই পুরোহিত ধৌম্য এবং মহর্ষি তৃণবিন্দুর অনুমতি নিয়ে পঞ্চপান্ডব গিয়েছিলেন মৃগয়ায় — মৃগয়াং পুরুষব্যাঘ্রা ব্রাহ্মণার্থে পরন্তপাঃ। অরণ্যআশ্রমে আর কিসের ভয় থাকতে পারে? অত্যন্ত নিশ্চিন্তে এই বৃদ্ধ দুইজন নিজ নিজ কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন৷ আর সেই মুহূর্তেই অরণ্যের পথ দিয়ে শাল্ব দেশে যাচ্ছেন সিন্ধুপতি জয়দ্রথ। নাঃ তিনি কোন রাজ্য দখলের লড়াইতে যাচ্ছেন না, তিনি যাচ্ছিলেন বিবাহ করতে। এর আগে যে শুধু দুঃশালা কে বিয়ে করেছিলেন এমন না, দুঃশলা ছাড়াও বেশ কয়েকটি বিবাহ তার ছিল। কিন্তু সমস্ত নারী থেকেই তার সরস মনোভাব উঠে যাওয়ার কারণে নতুন বিবাহের প্রয়োজন। আসলে পুরুষ রাজার কাম কিভাবেই বা থামিয়ে রাখা যায়।

কাম্যক বন সরস্বতী নদীর ধারে অবস্থিত ছিল। বেশ ঘন বন, এখানে না ছিল রাজপথ না বণিক পথ৷ তবে পুণ্যতোয়া সরস্বতীর কারণে নানান মুনি ঋষি বা ব্রাহ্মণ যাতায়াত করতেন। এই স্বল্প পদচারণের ফলে বৃহৎ রাস্তা না থাকলেও একটা সংকীর্ণ রাস্তা তৈরি হয়েছিল যে রাস্তা শ্বাল্য-দেশে কম সময়েই পৌঁছে দেয়। জয়দ্রথের যাত্রাকাল যাতে কম সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন হয় তাই এই পথ অবলম্বন করেছিলেন। এদিকে পান্ডবরাও এখানে তাদের বসবাসের জন্য পর্নকুটির নির্মাণ করেছিলেন এই ভেবে যে, সাধারণ জনপদ ও কোলাহল থেকেও একটু দূরে থাকা যাবে, আর প্রয়োজনে কম সময়ে অন্য রাজ্যেও যাওয়া যাবে।

জয়দ্রথ পাড়ি দিচ্ছেন, আর মুণিঋষিরাও নিজে নিজে কাজে ব্যস্ত। দ্রৌপদী তখন পর্নকুটিরের দরজা ধরে বাইরের প্রকৃতি দেখছেন আর হারিয়ে যাচ্ছেন নানান ধরনের চিন্তায়। বনের মধ্যে সচরাচর কারো তো পদচরণ শোনা যায় না, তাই অল্পেই সে সজাগ হয়। জয়দ্রথ ভাবতে পারেননি এমন ঘন জঙ্গলের ভেতর কোন নারীকে সে দেখতে পাবে কিংবা কোন কুটির থাকবে। আকাশে যখন বিদ্যুৎ চমকায় আমরা চাই বা না চাই আমাদের চোখ কিন্তু সেদিকেই চলে যায় ঠিক সেই ভাবেই জয়দ্রথও দ্রৌপদীকে দেখতে পেয়েছিলেন। 'তিষ্ঠন্তীম্ আশ্রমদ্বারি দ্রৌপদীং নির্জনে বনে!'

এখানে দ্রৌপদীকে শুধু যে জয়দ্রথ দেখেছিলেন তা নয়। জয়দ্রথীর সৈন্য সমেত সাথে যারা ছিল তারাও দেখেছেন। তবে দ্রৌপদীকে চিনতে না পেরে প্রথমে ভেবে ফেলেছিলেন যে এটি স্বর্গের কোন দেবতার মায়া, যে জাল পেতে বা ফাঁদ পেতে তাদের ধরার চেষ্টায় আছে। তবে জয়দ্রথ ঠিকই বুঝেছিলেন যে ইনি পাণ্ডব ভার্জা দ্রৌপদী। দ্রৌপদী সে যুগে ভারতবর্ষের মধ্যে সবথেকে সুন্দরী নারী ছিলেন। তাকে দেখে জয়দ্রথের কাম নিজের অধীনে থাকলনা। ভোগ করার জন্য উদ্ধত হন। এই চরিত্রটির এই দিকটি উল্লেখ করে আমার মনে হয়েছে মহাকবি দেখিয়েছেন, সেই যুগের নয় যুগে যুগে পুরুষের ভেতর যে একটি জানোয়ার ঘুমিয়ে থাকে এবং প্রয়োজনে তা জাগতে পারে, অশ্লীল হতেও তাদের বিবেকে বাঁধে না। সত্যিই তো এমন পুরুষ আমরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখি যারা কোন নারীর মন, গুণ কিংবা ইচ্ছে- অনিচ্ছের কথা না ভেবে সরাসরি নিজের কামুক স্বভাবকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জয়দ্রথও অনেকটাই এই ধরনের পুরুষ। দ্রৌপদীকে দেখেও তার একই রকম অনুভূতি। তার বন্ধু রাজা কোটিকাস্যকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে তিনি যেন জেনে আসতে পারেনন। "কস্য ত্বেষানবদ্যাঙ্গী যদি বাপি ন মানুষী?"
এখানে জয়দ্রথের বিশেষ একটা যে জানার বা শোনার প্রয়োজন ছিল তা নয় কারণ তিনি যাচ্ছিলেন বিবাহ করতে। তবুও লোভ তো তা থেমে যাওয়াটা খুবই কঠিন। যে কারণে তিনি কোটিকাস্যের কাছে বলেছিলেন 'বিবাহার্থো ন মে কশ্চিদিমাং প্রাপ্যাতিসুন্দরীম।অর্থাৎ রাস্তার মধ্যে যদি এমন সুন্দর এক মেয়েকে দেখতে পাওয়া যায় তবে তার আর কি প্রয়োজন দূর দেশে গিয়ে বিবাহ করে আনার । জয়দ্রথের কিছু কিছু মন্তব্য বারবার বলে দেয় সে কোনরকম সম্মান আদানপ্রদানের জন্য আসেনি। তবে রূপের কদর করে তিনি বলেছিলেন 'বরারোহা'। তিনি সরাসরি নিজে যাননি তার দুষ্টুচিত্তের সঙ্গী কোটিকাস্যকে পাঠিয়েছিলেন। তিনিও যথাসম্ভব সুব্যবহার করে দ্রৌপদীর আসল পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন। ঠিক যেন শিয়াল এসে সিংহের স্ত্রী এর পরিচয় জিজ্ঞেস করছেন। সেই জঙ্গল মধ্যে সে একা কিনা তাও জানতে চেয়েছিলেন। দ্রৌপদীর জীবনে তো আর ঘটনা শেষ নেই তাই তাকে অভিজ্ঞই বলা চলে। যার ফলে দূর থেকে কোটিকাস্য ও জয়দ্রথ কে দেখে তিনি অনেকটাই অনুমান করে ফেলেছিলেন। তাই প্রথম থেকেই বেশ কঠিন হয়ে কথা বলছিলেন এবং সুযোগ বুঝে তার আসল পরিচয় বাবা এবং স্বামীদের কথা বলে পরিষ্কার বুঝিয়ে দেন যে তিনি একেবারে অসহায় বা একা নন। এও জানিয়ে দেন তার স্বামীরা সামান্য দূরবর্তী অঞ্চলে মৃগয়া করতে গেছেন। এইসব বলার পর দ্রৌপদীর মনোবল বৃদ্ধি হয় ওদেরকে কুটিরে অবস্থান করতে বলে। কোটিকাস্য এসব কথা জানানোর জন্য গেলেই জয়দ্রথ সেসব না শুনেই তিনটি কথা বলেন , এই মহিলাকে কথা বলতে দেখেই অভিভূত; তুমি কাজ না গুছিয়েই ফিরে এলে কেন? তৃতীয় কথাটাই সাংঘাতিক, দ্রৌপদীকে দেখার পর থেকেই অন্য সমস্ত স্ত্রীকে তিনি বানরীর মতো দেখছেন। এই তিনটি কথাতে আরো বেশি করে স্পষ্ট হয় জয়দ্রথের ঘৃণ্য মানসিকতার। কেউ কতখানি কামুক হলে এই ধরনের কথা বলতে পারি। বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো উচ্চারণ করা মানেই কোন নারীকে না ছুঁয়ে ধর্ষণ করা। সে যুগে দাঁড়িয়ে কবি এতটা দূরের কথা ভেবেছেন এটাই আশ্চর্যজনক। তবে এই ধরনের লোক হয়তো যুগে যুগেই রয়েছে।

চলবে।

1000205476.png


1000216462.png

পোস্টের ধরণজেনারেল রাইটিং
ছবিওয়ালানীলম সামন্ত
মাধ্যমমেটা এ আই
লোকেশনপুণে,মহারাষ্ট্র
ব্যবহৃত অ্যাপক্যানভা, অনুলিপি


1000216466.jpg


১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে


1000192865.png


~লেখক পরিচিতি~

1000162998.jpg

আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।

🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾


1000205458.png

C3TZR1g81UNaPs7vzNXHueW5ZM76DSHWEY7onmfLxcK2iQHKgX7itFyjwbsWanwCxVcpznVPoq74AD9choMCjeWYrTCNC9tGGPVurQJpuwtKhZHHZy98cbp.png

C3TZR1g81UNaPs7vzNXHueW5ZM76DSHWEY7onmfLxcK2iQWqhxxsnyoVYgy5NrLetuJsNGL7qNkULJzJnsWirFd4h3YfksobeNxa5RExcnMgKbhJME1FNai.png

1000205505.png

Sort:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

 16 days ago 
1000419268.jpg1000419233.jpg1000419232.jpg1000419231.jpg
1000419230.jpg1000419229.jpg1000419228.jpg
 13 days ago 

মহাভারত আমার পড়া আছে। জয়দ্ব্রথ সম্পর্কে মোটামুটি জানা আছে। দ্রোপদি কে যেদিন অপহরণ করার চেষ্টা করেছিল ঐদিন ওকে হত‍্যা করলে কুরুক্ষেএের যুদ্ধে পান্ডবদের একটা শএু কমে যেত। যদিও পরবর্তীতে অর্জুন এক বিশেষ অস্ত্রের সাহায্যে থাকে বধ করে।

 13 days ago 

জয়দ্রথকে ওখানে বধ করলে অভিমন্যু বধ করা মুশকিল ছিল। আর অভিমন্যুকে বধ না করলে অর্জুন শেষের যুদ্ধটা করতেই পারত না বলে আমার ধারণা। কারণ অর্জুনের মনে আবেগগুলো অনেক বেশি জাঁকিয়ে বসেছিল।

সব কিছুই একে অপরের সাথে জড়িত। ঠিক যেন একটি অট্টালিকার সাজানো ইট।

Coin Marketplace

STEEM 0.12
TRX 0.23
JST 0.031
BTC 79869.57
ETH 1588.25
USDT 1.00
SBD 0.66