রাইকিশোরীকে লেখা শ্যামের চিঠি। পত্রসাহিত্য রচনা।
রাইকিশোরীকে লেখা শ্যামের চিঠি
আমার রাইকিশোরী,
আজ ঝুলনের দিনটি বড় মনে পড়ে। যেদিন বাজুবন্ধে তাকিয়ে আমি তোমার মুখের দিকে প্রথম দৃষ্টি ফেলেছিলাম নিঃসংকোচে। সমস্ত ব্রজবাসির মাঝখানেও আমি তোমার অন্তর্নিহিত দৃষ্টি প্রত্যাশী। আজ কতবার তুমি বাঁশির শব্দ নির্ভুল শুনেছ বলতে পারো? হয়তো কুঞ্জবটে তাকিয়ে দেখার আগেই সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়েছে ব্রজের প্রতিটি ঘরে। আর আমি নিকুঞ্জবনে অপেক্ষায় কাটিয়েছি শেষ আটটি প্রহর। আমি জানি, তুমি বৃষভানু নন্দিনী রাধে। আমার কপালে বর্ষাণার প্রতিটি ময়ূর যত্ন করে সেই তিলক বুনে দিয়েছে শেষ রাত্রি জুড়ে। সেই ছবিতে ভর করে আজ নিকুঞ্জবনের প্রতিটি হেলে পড়া গাছ হয়ত তোমার কথা বলে যাচ্ছে অহরহ। আমি কেন এত অপেক্ষা করি রাই? এই অপেক্ষাতেই কি শিখিপাখা মলিন হাওয়ায় দুলে ওঠে নিজের অজান্তেই? কই আমি কেন দেখতে পাই না তাকে? আসলে নিজের রাজমুকুটে আজ পর্যন্ত তাকিয়ে দেখিনি একবারও। বরং আমি রাইঅঙ্গে প্রতিদিন এঁকেছি সেই মুকুটের অলংকার। আর তুমিও অগোচরে চিনে নিয়েছো প্রত্যেকটি গহনার আঁকিবুকি। কে বলে ব্রজধাম আজ একা? হয়তো দ্বারকানগরীর মুখ্য দরজার প্রতিটি স্তম্ভ তোমায় চেনে না। হয়তো প্রহরী দরজার সামনে নিজেদের ক্ষমতা বলে তোমাকেও আটকে দেবে কোনোদিন। কিন্তু তারাও এই রাজপুরীতে পাহারা দেয় আমার একান্ত নিকুঞ্জবন। প্রতিটি নাগরিকের ঘরে অনর্গল জানিয়ে দেয় ব্রজপ্রেমের মাহাত্ম্য। প্রতিদিন কেউ আমাকে নিয়ম করে জিজ্ঞাসা করে, ওহে রাজা, কে তোমার রাই? তাই আমি প্রতিদিন ভোরে ভাবি এ ভুমি দ্বারকা নাকি আমার রাই কিশোরীর ব্রজভূমি? উত্তর তুমি দিও।
ফিরে পড়া শিখি পাখায় এখনো বর্ষাণার চিত্রপট। বর্ষা এখানেও আসে। ভিজিয়ে দেয় আমার গায়ের সমস্ত রাজপোশাক। লোকে বলে, রাজা তুমি ভিজো না। কিন্তু আমি বলি, শ্রীরাধার মানভঞ্জনে আমার ভিজে পোশাকের মাহাত্ম্যকথা। যদিও কাউকে রাইকিশোরীর প্রভাব বোঝাবো সেই ইচ্ছা আজ আর আমার নেই। হয়তো এতক্ষণে পায়ের কাছে এসে বসে আছে অর্জুন। মাথায় এসে অপেক্ষা করছে কৌরব শিরোমণি দুর্যোধন। সকলে দেখবে আমি চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলাম ধনুর্ধর অর্জুনের দিকে। কিন্তু সেই দৃষ্টিতেও তোমার অক্ষয় নির্ভরতা বেঁচে ছিল দুর্নিবার। তখন অর্জুন আর দুর্যোধনের তেজে শিহরিত নগরী। ঠিক তার আগেই কপর্দকশূন্য সুদাম সখা এনে দিয়েছে নন্দগাঁওয়ের খবর। কিন্তু স্বর্ণ দ্বারকা তখনও অন্ধকার। কুরুক্ষেত্রের প্রাক্কালে দুই মহারথীর মাঝখানেও আমার দেহ মনের বিভাজন একত্রিকরণে তোমার ভূমিকাই সর্বাধিক রাইকিশোরী। আমি তখনো গাই, "এসো এসো রাই, তোমারে সাজাই, শ্যাম সোহাগের ভূষণে"।
তুমি কি এই যোদ্ধা শ্যামের স্বপ্ন দেখো? আজও কি দেখো নিধুবনের প্রতিটি পাতায় কিভাবে ভোরের কিরণ প্রথম এসে রাঙিয়ে দিতে সব কিছু? সমস্ত ব্রজভূমি জুড়ে সূর্যের দ্রবীভূত আলোয় তুমি কি এখনো খুঁজে ফেরো আমার স্মৃতিচিহ্নগুলো? গোবর্ধন পাহাড়ে সেদিন প্রথম আমার আঙুল ছুঁয়েছিলে তুমিই। তাই আজও আমার প্রতিটি বিশ্বরূপ প্রদর্শনেও তোমার নির্ভরশীলতা স্পষ্ট।
তবে আমার স্বপ্নে বারবার কী আসে? দুপারের রণশয্যায় সজ্জিত বীরশ্রেষ্ঠ দুই পক্ষের রথী ও সেনাবাহিনী নাকি নিকুঞ্জবনের প্রত্যেকটি রাইরঙ্গিনী পাতায় তোমার অধরা স্বপ্নগুলোর ছায়া? আমি কোন পক্ষে ঠাঁই নেব আজ?
ধর্মযুদ্ধের শেষে যখন মাঠ জুড়ে পড়ে থাকবে অধর্মের নির্জনতা, যখন শেষ ছায়ায় মুছে যাবে যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতিটি হেলে পড়া ঘাস, ঠিক তখনই আমি তোমার সামনে ঘোষণা করব আমার প্রকৃত নির্ভরতা। সেদিন তুমি জেনে নিও আমার প্রকৃত স্বরূপ আর ব্রজভূমিকে বলে দিও একমাত্র তুমি শ্যামহীন নয়। আসলে যমুনার জলে তোমার প্রত্যেকটি ভিজে আঙুল আমার ফেলে আসা রঙিন পথের সুনির্দিষ্ট দাবিদার। সেই দাবিটুকু বুঝে নাও রাই। তোমার শ্যামকে বেঁধে নাও তোমার জন্মসিদ্ধ গভীরতায়।
ইতি
তোমার শ্যাম
(৫% বেনিফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
বাঁশি ছেড়ে অসি যেদিন ধরেছিল শ্রী-কৃষ্ণ রাইকে ভুলে গিয়েছিল। রাই কোনদিন ভুলতে পারেনি।
তবে আমার মনে হয় কেউ কাউকে ভোলে না৷ শুধু ভুলে যাবার ভান করে। আজও রাই তার মাধবের কথাই ভেবে চলে। দিনের প্রতি প্রহরে শুধু বাঁশির আওয়াজই খুঁজে চলে।
চমৎকার পত্র লিখলে৷ আমি পড়তে পড়তে ভাবছিলাম আজকাল মহাভারতে কে ডুবে আছে! হা হা হা৷ অসম্ভব সুন্দর লেখা। এমন মিষ্টি সাহিত্য ছড়িয়ে যাক দিকে দিকে।
তুই ঠিকই বলেছিস। কৃষ্ণ সব সময় রাইয়ের কথাই ভেবে জলে। আজ রাধা অষ্টমীর শুভেচ্ছা।