ক্রিক রো - কলকাতার হারিয়ে যাওয়া খালের স্মৃতিপথে
পুরনো কলকাতা ও তার কথা
কলকাতা তখন আজকের কলকাতা নয়। ডাকাত আর ঠ্যাঁঙাড়েদের চারণভূমি। আজকের শহরের থেকে তার রূপও সম্পূর্ণ আলাদা। ধীরে ধীরে বদলে গেছে আমাদের শহর। বদলে গেছে জনবসতিও। কয়েকটা অজ পাড়াগাঁ রূপ বদলে আজকের তিলোত্তমা। কিন্তু সময়ের চাকায় পিষ্ট হয়ে হারিয়ে গেছে কতকিছু। বারবার ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে নতুন নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে আমাদের কলকাতা। কিন্তু আজও পুরনো শহরের বহু বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায় ধরা রয়েছে বিভিন্ন রাস্তা, গলি অথবা জায়গার নামের মধ্যে। রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার বা ওয়েলিংটন স্কোয়ারের পাশ দিয়ে আড়াআড়ি একটা রাস্তা চলে গেছে মৌলালির দিকে। নাম তার ক্রিক রো৷ রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো বাড়িগুলোরও অদ্ভুত গঠনশৈলী। প্রায় সব পুরনো বাড়িগুলোতে আজও ঘাটে নামার মত ধাপ সিঁড়ি। যেন এককালে শিশুকে কোলে নিয়ে এই সিঁড়ি বেয়ে নেমেই কলসিতে জল নিয়ে উঠে আসত স্থানীয় মহিলারা। ক্রিক অর্থাৎ ছোট খাঁড়ি বা খাল। কিন্তু মধ্য কলকাতার ব্যস্ত জনপদে আবার জলজ্যান্ত একটা খাল? এ আবার কেমন কথা? অথচ ক্রিক রোয়ের নাম থেকে শুরু করে বাড়ির সামনে লম্বা লম্বা ধাপ, সবকিছুর মধ্যে দিয়েই সাক্ষী দেয় সেই খালের। গঙ্গা তো বিস্তর দূর। তাহলে এই ক্রিক রো এর মধ্যে লুকিয়ে আছে কোন খালের ইতিহাস? এবার আসা যাক সেই পুরনো শহরের ভৌগলিক মানচিত্রে। তখন গঙ্গা থেকে একটা খাল বেরিয়ে শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়ে সোজা গিয়ে পড়ত শহরের পূর্বপ্রান্তে লবনহ্রদে। আজকের অভিজাত সল্টলেক সিটি। অষ্টাদশ শতকে ইংরেজদের প্রকাশিত মানচিত্রে স্পষ্ট সেই খালের অস্তিত্ব। তবে কেমন ছিল সেই ঐতিহাসিক খালের গতিপথ? বর্তমান বাবুঘাটের কাছ থেকে এই খাল বেরিয়ে চাঁদনী চক, তালতলা স্ট্রিট হয়ে গিয়ে পড়ত লবনহ্রদে। শহরের প্রথম ভিনদেশী অতিথি ইংরেজ নয়। তার আগেও বাংলা ছিল মগ, পর্তুগীজদের দখলে। যদিও সুষ্ঠু বাণিজ্য তো নয়ই, নবাবী আমলে দস্যুবৃত্তি ছাড়া অন্য কোনো দিকে তারা খুব একটা মনোনিবেশ করেনি আগাগোড়াই। গঙ্গা ও তৎসংলগ্ন জলাভূমি ছিল তাদের বিস্তীর্ণ মুক্তাঞ্চল। কলকাতার এই হারিয়ে যাওয়া খালও ছিল তাদের মুক্ত বিচরণভূমি। শোনা যায় একসময়ে ক্রীতদাস আমদানী রপ্তানির একটা প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছিল খালটি। পাড় ঘেঁষে জেলে প্রজাতির মানুষের বসতি আর বিক্ষিপ্ত বাড়িঘর ছাড়া পুরো অঞ্চলটিই ছিল গভীর জঙ্গল। এরপরই শহরে এলো বেনিয়া ইংরেজ। পলাশীর যুদ্ধ জিতে জঙ্গল কেটে কলকাতার রূপ পরিবর্তনে হাত লাগালো তারা। হাজার হোক, এ তাদের নিজের হাতে তৈরি করা প্রাণের শহর। ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করলো বাঙালীর প্রাণের কলকাতা। এরমধ্যেই ১৭৩৭ সালের সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে শহরে আছড়ে পড়লো এক মূর্তিমান বিপদ। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়, সঙ্গে ভূমিকম্প। কতকিছু ধ্বংস হয়ে গেল একরাতের মধ্যে। প্রবল ঝড়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো ইংরেজদের নতুন কাঁচা ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ, সেন্ট অ্যানস চার্চ, এমনকি ব্ল্যাক-জমিদার গোবিন্দরাম মিত্রের প্রতিষ্ঠিত নবরত্ন মন্দির, চিত্তেশ্বরী কালী মন্দিরও (যাঁর নামে আজকের চিৎপুর)। ডুবে গেল কোম্পানির বেশ কয়েকটি বড় বাণিজ্য জাহাজ। ভেঙে গেল প্রায় সমস্ত কাঁচাবাড়ি। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহ আর ভগ্নাবশেষের মাঝখানে একরকম শ্মশানে পরিণত হল কলকাতা। এখনও তালতলার ক্রিক রো বা ডিঙাভাঙা লেন এই ঝড়ের রাতে এক নৌকাডুবির বিধ্বংসী স্মৃতিটুকু ধরে রেখেছে বুকে করে। আজকের উল্টোডাঙা নামের সাথেও মিশে আছে সেই খালে নৌকাডুবির ইতিহাস। অর্থাৎ আজকের কলকাতার অঞ্চলভিত্তিক নামগুলোই জানান দেয় সেযুগের সেই হারিয়ে যাওয়া খালের গতিপথ। কিন্তু আজ কোথায় গেল সেই খাল। নিজেদের সুবিধামত বারবার শহরের খোলনলচে বদলে ফেলেছে ইংরেজ কোম্পানি। তাই সেই প্রবল ঝড়ের পরে মজে যাওয়া খালও বুজিয়ে ফেলা হয়েছে ধীরে ধীরে। বদলেছে গঙ্গারও গতিপ্রকৃতিও। কিন্তু আজ আর খাল না থাকলেও রয়ে গেছে ক্রিক রো বা ডিঙাভাঙা লেন অথবা উল্টোডাঙার মত জায়গার নামগুলো।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(৫% বেনিফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
দাদা,আপনার পোস্টগুলো যখনই পড়ি তখনই নতুন বিষয়ের সন্ধান পাই।যেটা আমার কাছে বেশি ভালো লাগে তেমনি আজো একটি নতুন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারলাম।কলকাতার মধ্যে যে এত বড় একটি খাল ছিল আর সেটা বাণিজ্য পথের কাজ করতো ভেবেই অবাক হলাম।সেই খাল এখন শহরের রাজপথে মিশে গেছে, ধন্যবাদ দাদা।
এমন সুন্দর মন্তব্য করে আমার পাশে থাকবার জন্য অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।
https://x.com/KausikChak1234/status/1845916587745755315?t=fzHTkRecCFnNa1COc607-w&s=19
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
পুরো লেখাটা একটা প্যারাগ্রাফে হয়েছে ভাই, একাধিক প্যারাগ্রাফ হলে আরো একটু বেশী সুন্দর দেখাতো। ধন্যবাদ।
আচ্ছা হাফিজ ভাই। খেয়াল রাখব এবার
কৌশিকদা'র লেখা মানেই নতুন কিছু জানা। খুবই ভালো লাগলো দাদা। ভূমিকম্প আর ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাস জানা ছিলো না। আসলে, এখানে উল্লেখকৃত কোন কিছুই আমার জানা ছিলো না। ভালো লাগলো পড়ে।
বাংলা লেখা পড়ে আপনি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেন বলে খুব অনুপ্রাণিত হই ভাই। ভীষণ ভালো থাকবেন।
আপনিও ভালো থাকবেন। আর হ্যাঁ, এমন লেখা লিখতে থাকবেন।